Friday 5 December 2014

আল্লাহ্‌র বড়ত্ব


بسم الله الرحمن الرحيم

ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহিমাহুল্লাহ তার আল-ওয়াবিলুস সায়্যিব গ্রন্থে আমাদের মহান রব আল্লাহ্‌ আজ্জা ওয়া জালের বড়ত্বের কথা অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছেন এভাবেঃ 

" তিনি সব রাজত্বের কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করছেন, নির্দেশ দিচ্ছেন এবং নিষেধ করছেন এবং রিজিক দিচ্ছেন, মৃত্যু দিচ্ছেন এবং জীবিত করছেন। মর্যাদা দিচ্ছেন এবং অপমানিত করছেন, দিন-রাত্রির আবর্তন ঘটাচ্ছেন, মানুষের মাঝে (সুখ-দুঃখের) দিন ঘুরাচ্ছেন। রাজ্যসমূহ পরিবর্তিত করছেন ফলে কোন রাষ্ট্র রাখছেন আবার কোনটিকে ধ্বংস করে আরেকটি গড়ছেন। তাঁর নির্দেশ আকাশে-বাতাসে সমুদ্রে সর্বত্র বাস্তবায়িত হচ্ছে। তিনি সবকিছুকে তার জ্ঞান দ্বারা পরিবেষ্টিত করে রেখেছেন। তাঁর শ্রবণশক্তি সকল কণ্ঠকে ব্যপ্ত করে রেখেছে, তার নিকট এক কণ্ঠস্বর অন্য কণ্ঠস্বরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ঠেকে না, বরং সব ভাষায় সব কথাই তিনি একসাথে শুনতে পাচ্ছেন। তাকে অধিক প্রার্থনা ও যাঞ্চা ভ্রান্তিতে ফেলতে পারে না এবং আকুতি-মিনতিকারীদের কাতরকণ্ঠ তাঁকে বিরক্ত করতে পারে না। তাঁর দৃষ্টিশক্তি সব কিছুই অবলোকন করছে এমনকি কালোপাথরের উপর দিয়ে অন্ধকার কাল পিপীলিকার দল গেলেও তাঁর দৃষ্টি এড়ায় না। সুতরাং অদৃশ্য তাঁর নিকট প্রকাশ্য এবং গোপনীয় বিষয় তাঁর নিকট স্পষ্ট, তিনি গুনাহ মাফ করছেন, বিপদ্গ্রস্থকে উদ্ধার করছেন, দুঃখীকে মুক্ত করছেন, রিক্ত হস্তকে দান করছেন, পথভ্রষ্টকে পথের দিশা দিচ্ছেন, কিংকর্তব্যবিমুঢ়কে চেতনা দিচ্ছেন, ক্ষুধার্থকে খাবার দিচ্ছেন, উলঙ্গকে বস্ত্র দান করছেন, পীড়িতকে আরোগ্য দান করছেন, তওবাকারীর তওবা কবুল করছেন, সৎকাজকারীকে প্রতিদান দিচ্ছেন এবং মজলুমকে সাহায্য করছেন আর অত্যাচারীকে পদানত করছেন। সম্মানীর সম্মান রক্ষা করছেন এবং আশ্রয়হীনকে নিরাপত্তা দান করছেন। তিনি বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর উত্থান ঘটাচ্ছেন আবার কিছু জাতিকে ধ্বংস করছেন... যদি আকাশ ও জমিনের পূর্বের ও পরের মানুষ এবং জিন সকলেই তাঁর অনুগত বান্দা হয়ে যায় তাহলে তাঁর রাজত্ব সামান্যতম বৃদ্ধি পাবে না। আর যদি পূর্বের এবং পরের সমস্ত মানব ও দানব তাঁর অবাধ্য হয়ে যায় তাহলেও তাঁর রাজত্বে সামান্যতম ঘাটতি হবে না। দুনিয়া ও আকাশের সমস্ত মানুষ ও জিন জীবিত ও মৃত সকলেই যদি কোথাও একত্রিত হয়ে তাঁর নিকট প্রার্থনা করে এবং তিনি প্রত্যেককে তার প্রার্থিত বস্তু দান করেন তাহলে তাঁর ভাণ্ডার থেকে সামান্যতম জিনিসও কমবে না। তিনিই প্রথম, যার পূর্বে আর কেউ নেই। তিনিই প্রকাশ্য যার উপরে আর কেউ নেই এবং তিনিই অপ্রকাশ্য যার পিছনে আর কেউ নেই। তিনিই বরকতময়, যার ভাণ্ডার হতে কোন কিছু ঘাটতি হবে না। যার কোন শরীক নেই, নেই কোন প্রতিপক্ষ, যিনি কারো মুখাপেক্ষী নন, সৃষ্টিকূলে যার কোন তুলনা হয় না। সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে একমাত্র তাঁর রাজত্ব ব্যতীত। তাঁর অনুমতি ব্যতীত কারো আনুগত্য নেই। কেউ তাঁর জ্ঞানের বাহিরে অন্যায় করতে পারে না। কেউ আনুগত্য করলে তিনি খুশী হন, পাপ করলে ক্ষমা করে দেন। তাঁর পক্ষ থেকে প্রতিশোধ হলো ইনসাফ স্বরূপ। তাঁর প্রতিটি নিয়ামত রহমত স্বরূপ। তিনি সবার হিফাজতকারী, যা ইচ্ছা তাই করেন। ["তিনি কোন কিছু ইচ্ছা করলে বলেন, হয়ে যাও, তখনই তা হয়ে যায়।" - সুরা ইয়াসিনঃ৮২]" 

( আল-ওয়াবিলুস সায়্যিব, পৃষ্ঠাঃ ১২৫ ) 
                                             


"আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই, তিনি জীবিত, সবকিছুর ধারক। তাঁকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না এবং নিদ্রাও নয়। আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে, সবই তাঁর। কে আছ এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? দৃষ্টির সামনে কিংবা পিছনে যা কিছু রয়েছে সে সবই তিনি জানেন। তাঁর জ্ঞানসীমা থেকে তারা কোন কিছুকেই পরিবেষ্টিত করতে পারে না, কিন্তু যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন। তাঁর সিংহাসন সমস্ত আসমান ও যমীনকে পরিবেষ্টিত করে আছে। আর সেগুলোকে ধারণ করা তাঁর পক্ষে কঠিন নয়। তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বাপেক্ষা মহান।" [সুরা বাকারাহঃ ২৫৫]  

"তিনিই প্রথম, তিনিই সর্বশেষ, তিনিই প্রকাশমান ও অপ্রকাশমান এবং তিনি সব বিষয়ে সম্যক পরিজ্ঞাত।"  [সুরা হাদীদঃ০৩] 

"তিনিই আল্লাহ তা’আলা, তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই; তিনি দৃশ্য ও অদৃশ্যকে জানেন তিনি পরম দয়ালু, অসীম দাতা। তিনিই আল্লাহ তিনি ব্যতিত কোন উপাস্য নেই। তিনিই একমাত্র মালিক, পবিত্র, শান্তি ও নিরাপত্তাদাতা, আশ্রয়দাতা, পরাক্রান্ত, প্রতাপান্বিত, মাহাত্নøশীল। তারা যাকে অংশীদার করে আল্লাহ তা’ আলা তা থেকে পবিত্র। তিনিই আল্লাহ তা’আলা, স্রষ্টা, উদ্ভাবক, রূপদাতা, উত্তম নাম সমূহ তাঁরই। নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবই তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়।" [সুরা হাশরঃ ২২-২৪]  

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

"যখন আল্লাহ্‌ আসমানে কোন নির্দেশ জারি করেন তখন ফিরিশতাকূল আল্লাহ্‌র ভয়ে বিনয়ী হয়ে পাখা নাড়তে থাকে যেন তারা লোহার শিকলে পাথরে বাঁধা রয়েছেন, যখন তাদের অন্তঃকরণ থেকে ভয় বিদূরিত হয় তখন তারা বলে আপনাদের প্রভু কি বলেছেন, তারা বলে তিনি অবশ্যই সত্য বলেছেন। তিনি সর্বোচ্চ ও সুমহান।"  [ বুখারিঃ হাদিস নং- ৪০৪৩] 


 "তারা আল্লাহকে যথার্থরূপে বোঝেনি। কেয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোতে এবং আসমান সমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে। তিনি পবিত্র। আর এরা যাকে শরীক করে, তা থেকে তিনি অনেক উর্ধ্বে।" [সুরা আয-যুমারঃ৬৭]

    
[ সালিহ আল-মুনাজ্জিদের 'ঈমানী দুর্বলতা' বই থেকে, অনুবাদকঃ শামাউন আলি] 

Sunday 9 March 2014

শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়াহ্

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

তাইমিয়াহ  ছিলেন একজন মহিলা আলিমার নাম আর তার বংশধরদের মধ্যেও অনেকেই আলিম হয়েছিলেন; তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত জনের নাম ইবনু তাইমিয়াহ্। এই পরিবারের রয়েছে ইসলামের প্রতি অবদানের অনন্যসাধারণ কাহিনী। একটি উদাহরণই যথেষ্ট। এটি তাতারদের ইরাক আক্রমণের সময়কালে যখন লোকজন বড়সড় আক্রমণের ভয়ে খুব বেশীই স্থান পরিবর্তন করছিলো। আর বাগদাদের ইসলামিক লাইব্রেরি পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা তখন মাত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ইবনু তাইমিয়াহ্ ছোট বালক কিন্তু তার বাবা, চাচা, দাদারা তখনি আলিম। তারাও অন্যত্র যাওয়ার জন্য মনস্থির করলেন কিন্তু পরিবারের খুববেশী আসবাব তাদের সাথে নেননি বরং তাদের সমস্ত ইসলামী বইয়ের সংগ্রহশালা একটি মালবাহী গাড়ীতে তুললেন আর তারা নিজ হাতেই তা ঠেলে নিয়ে গেলেন।

এই ছিলো ইবনু তাইমিয়াহর উত্তরাধিকার যা তিনি লাভ করেছিলেন আর তার মাধ্যমে আমরা দ্বীনের জ্ঞান পেয়েছি এই দিন পর্যন্ত। যে বইগুলো ওই মালবাহী গাড়ীর মাধ্যমে রক্ষা করা হয়েছিলো তা ইবনু তাইমিয়াহকে তার জীবদ্দশায় আরো ৫৯১ টি বই লিখতে সহায়তা করেছে তাও মাত্র ৬৭ বছরের জীবনে! মুসলিম বিশ্ব পেয়েছে তার মাধ্যমে ইবনু কাসীর, ইবনুল কায়্যিম জাউযি আর ইমাম আয-যাহাবীর মত আলিমদের। এরা সকলেই ছিলেন তার ছাত্র। এই উত্তরাধিকারই তিনি রেখে গেছেন: জ্ঞান আর জ্ঞানের ধারক আলিম।

মূলতঃ ইবনু তাইমিয়াহ্ খুবই ছোটবেলায় দ্বীন শিক্ষার প্রাথমিক জ্ঞান আর উদ্দীপনা পেয়েছিলেন তার দাদা, বাবা আর চাচার কাছ থেকে। সময় ব্যবস্থাপনার এক স্বতন্ত্র উদাহরণ যেনো তিনি। একবার ইবনু তাইমিয়াহর পিতা ছোট বাচ্চাদের বাগানে নিয়ে গেলেন কিন্তু ছোট তাইমিয়াহ্ বেঁকে বসলেন। যখন তার পিতা ফিরলেন তখন জানালেন এই সময়ের মধ্যে তার একখানি বই মখস্থ করার ছিলো। ইবনু তাইমিয়াহ্ মোট তিনবার কারা নির্বাসনে যান আর তিনবারই তা লোকজনের আর তথাকথিত মুসলিমদের সরকারের নিকট অভিযোগের কারণেই। তার প্রথম কারাবরন ছিলো গৃহবন্দীর ন্যায় যেখানে লোকজন তার সাথে দেখা করতে পারতো। তিনি ফাতাওয়া আর নাসিহা দিতেন; এভাবেই নিজের আখিরাহর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এরপর তিনি দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তার হন আর একবছরের মত কারারুদ্ধ থাকেন।

এরই মধ্যে তিনি দেখতে পেলেন লোকজনের আক্বীদা ক্রমশঃ বিকৃত আর বিভিন্ন মিথ্যা ধারনার অনুপ্রবেশ ঘটছে লোকজনের মনমগজে; তখনই তিনি তার অনন্যসাধারণ আক্বীদার বই যা তাওহীদের উপর রচিত:আল-আক্বীদাতুল ওয়াসিতিয়্যাহ্ লিখেন। এই বইটি তিনি লিখা শুরু করেন বা’দ আসর আর মাগরিব নাগাদ শেষ করেন। আপনি যদি এই বইটি পড়েন তবে খেয়াল করে দেখবেন এতে কি পরিমান কুরআনের আয়াতের উদ্ধৃতি রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে। আর আসর থেকে মাগরিব বড়জোর আড়াই থেকে তিন ঘন্টা সময় আর একটি বই এতো বেশী কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে রচনা কেবল এটাই প্রমান করে তিনি কতো গভীরভাবে কুরআন জানতেন। ইবনু তাইমিয়াহ্ কেবল সত্য সম্পর্কে লিখেই ক্ষ্যন্ত হননি তিনি মিথ্যার মুলোৎপাটন করেছেন তার লেখনীতে ও বক্তব্যে।

ইবনু তাইমিয়াহ্ যখন জেলে মৃত্যুবরণ করেন তখন জেলের মুয়াজ্জিন দেয়াল বেয়ে উঠে তার ঘোষনা দিলেন আর যখন তার জানাযা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো তখন প্রায় তিনলক্ষ লোকের সমাগম হয়েছিলো। খুব দ্রুতই সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছিলো। ইবনু রজব বলেন, তিনি ভ্রমনকারীদের নিকট এমনো সংবাদ পেয়েছেন তার গায়েবানা জানাযা ইয়েমেন ও চায়নায় পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।

সমকালীন পরিভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, ইবনু তাইমিয়াহ্ তার সময়ের অসাধারন সদ্ব্যবহার করেছিলেন; যার মধ্যে ছিলো একই বসায় প্রায় ৬০ পৃষ্ঠার কাছাকাছি মত লেখার সক্ষমতা, তার ছিলো ৩৫ ভলিউমের ফতোয়ার সংগ্রহশালা আর পাশাপাশি একদল শিক্ষার্থীকে একইসাথে তাফসীর, হাদীস, উসুল আত-তাফসীরের মত বিষয়াবলী শিক্ষাদান। তিনি তার কারাবরনকে ইতিবাচকভাবেই নিয়েছিলেন আর সেখানে থাকা অবস্থায় প্রায় আশি বার কুরআন অধ্যয়ন করেন।

ইবনু তাইমিয়াহ রহিমাহুল্লাহ একাধারে ছিলেন হাফিজ, ফকীহ, মুজতাহিদ, মুফাসসির, মুহাদ্দিস এবং মুজাহিদ।

Tuesday 11 February 2014

ইহসান

بسم الله الرحمن الرحيم

الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ

”যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন-কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাময়।  “ [সুরা মুলক: ৩]

এই আয়াহ’য় উল্লেখ করা হয়েছে আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের মধ্যে কে সর্বোত্তমভাবে কর্মসম্পাদনকারী তা তিনি পরীক্ষা করেন। আর এখানে ব্যবহৃত أَحْسَنُ عَمَلًا ‘র ব্যবহারে তাই প্রতীয়মান হয়; এখানে বলা হয়নি “আকছারু আ’মালা” অর্থ্যাৎ অধিক কর্মসম্পাদনকারী। এখানে ইবাদাহ্’র পরিমাণের চেয়ে গুণগত মানকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আ’মালের মধ্যে সর্বোত্তম। মুহাম্মদ বিন আজলান এর মতও এটাই। এটা খেয়াল রাখতে হবে যে, আল্লাহ্ তা’আলা বলেননি, “তোমাদের মধ্যে কে বেশী কর্মসম্পাদনকারী”? এরপরেই আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,”তিনি পরাক্রমশালী, দয়ালু”। এখানে আল্লাহ্’র পরাক্রমশালীতার পাশাপাশি ক্ষমার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।


 অন্যত্র একটি আয়াত এসেছে:

إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَى الْأَرْضِ زِينَةً لَّهَا لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا

"আমি পৃথিবীস্থ সব কিছুকে পৃথিবীর জন্যে শোভা করেছি, যাতে লোকদের পরীক্ষা করি যে, তাদের মধ্যে কে ভাল কাজ করে।" [সুরা কাহফ:০৭]   

অনুরুপভাবে আমরা হাদীসে জিবরীলে দেখি ইহসানের সংজ্ঞা:

قَالَ: مَا الإِحْسَانُ؟
قَالَ: «  ( يَرَاكَ» )أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ
[صحيح البخاري]


"তারপর বললেন, আমাকে ইহসান সম্পর্কে অবহিত করুন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: ইহসান হলো, এমনভাবে ইবাদত-বন্দেগী করবে যেন তুমি আল্লাহকে দেখছ, যদি তুমি তাকে না ও দেখ, তাহলে ভাববে তিনি তো আমাকে দেখছেন।" [সহীহ মুসলিম, ইফাবা, হাদীস নং-০১]

আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকে ইহসানের স্তরে উন্নীত করুন। আমীন।


Sunday 26 January 2014

দ্বীন হচ্ছে নাসিহা

                                                بسم الله الرحمن الرحيم




আবু রুকাইয়াহ তামিম ইবনু আওস আদ-দারী [রাযীঃ] হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ দ্বীন হচ্ছে উপদেশ। আমরা বললাম, কার জন্য? তিনি বলেনঃ আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসুলের জন্য, মুসলিমদের নেতা [ইমাম] এবং সমস্ত মুসলিমদের জন্য। [মুসলিমঃ হাঃ ৫৫]

আমাদের এই হাদিসটি অত্যন্ত গভীরভাবে উপলব্ধি করা দরকার কেননা ইসলামে নাসিহার গুরুত্ব অপরিসীম; এমনকি মুহাম্মাদ বিন আসলাম এই হাদিসকে বলেছেন দ্বীনের এক-চতুর্থাংশ।  

কিন্তু, আমরা এটা কতটুকু মনে রাখি? এই ব্যাপারে একজন আলিমের সমালোচনার ধরন তুলে ধরব যাতে আমরা শিক্ষা গ্রহন করতে পারি, ইন শা আল্লাহু তাআলা।

একবার এক ব্যক্তি এসে একজন আলিম পর্যায়ের ব্যক্তির কাছে অন্য এক ব্যক্তির ব্যপারে অভিযোগ করলো, যে সে ব্যক্তি কম্যুনিটিতে ফিতনা সৃষ্টি করছে। তখন, ঐ আলিম ব্যক্তি গীবাত আর অপবাদের সতর্কতা দেখিয়ে অভিযোগকারী ব্যক্তিকে বলল, “ঐ ব্যক্তি তাঁর নিজের প্রতি অবিচার করছে।”

দেখুন তাঁর প্রজ্ঞা। একজন ব্যক্তি যখন ফিতনা তৈরি করে তখন সবার আগে সে কাকে হতাশ করে তাঁর নিজেকেই; হয়তো উপলব্ধি ব্যতিরেকে। এরপর তিনি ব্যপারটি নিয়ে কথা বললেন। সুবহান’আল্লাহ।

কিন্তু, এসব ব্যাপারে আমরা কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাই। আমরা খুব সহজেই বিচার করে বসি; ঐ ব্যক্তির জন্য কোন সমবেদনা প্রকাশ না করে। যা নাসিহাকে পুরোপুরি অর্থহীন করে দেয়। অথচ যে ব্যক্তিকে উপদেশ দেয়া হল, তাকে উপদেশ দেয়ার পাশাপাশি দুয়া ও করা উচিত।

আমাদের ভাবা উচিত, আমরা কি নাসিহা [সদুপদেশ] দিচ্ছি নাকি তিরষ্কার করছি?

নাসিহা আর তিরস্কারের মধ্যে পার্থক্য হল, নাসিহা হল সে উপদেশ; এই উপদেশ যাকে দেয়া হচ্ছে তার প্রতি থাকে মঙ্গলকামিতা, থাকে রাহমা আর সহমর্মিতা আর সেই উপদেশদাতা কামনা করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন আর তার সৃষ্টির কল্যাণ। তাই সে তাকে চরম বিনয়ী আর এমনকি নিজেকে প্রস্তুত করে সমুহ ক্ষতি কিংবা অপবাদের গ্লানির জন্য ও। অপর দিকে যে তিরস্কার করে সে সন্মুখ সমরেই সবকিছু বলে আর অপদস্থ করে। সে যাকে তিরস্কার করছে সে ব্যক্তিকে খাট করতে চায় এবং উপদেশের নামে অভিশাপ দেয়।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষের হিদায়ার জন্য এত বেশী কাতর ছিলেন যে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা ওয়াহির মাধ্যমে জানালেনঃ

“যদি তারা এই বিষয়বস্তুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করে, তবে তাদের পশ্চাতে সম্ভবতঃ আপনি পরিতাপ করতে করতে নিজের প্রাণ নিপাত করবেন।“ [সুরা কাহফঃ০৬]

আল্লাহু আকবার।

এছাড়া ও সালাফদের মধ্যে হাসান আল বাসরির নাসিহার কথা সুবিদিত। একজন সালাফ বলেছিলেন, এখন আর হাসান আল বাসরির মত কেউ নাই যে শাসকদের নাসিহা দিবেন।

সুতরাং, আমাদের সব সময় নাসীহা দেয়ার ক্ষেত্রে সহমর্মিতা আর সমবেদনা বজায় থাকে তা খেয়াল রাখতে হবে । আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমীন। 

سبحانك اللهم و بحمدك أشهد أن لا إله إلا أنت أستغفرك و أتوب إليك


Saturday 25 May 2013

গান-বাজনা: শেষ এখানেই

بسم الله الرحمن الرحيم

প্রারম্ভিক কথা:
  • কোন সুসংবাদ কিংবা দুঃসংবাদ শুনলে আপনার মুখ দিয়ে প্রথমে কি কি শব্দ বেরিয়ে আসে। সুবহান'আল্লহ্, আলহামদুলিল্লাহ্ কিংবা আল্লহু আকবার নাকি একগুচ্ছ ইংরেজী অশ্লীল শব্দগুচ্ছ। একটু খেয়াল করুন, যেখানে আপনি সম্পূর্ণ সচেতন আর সুস্থ মস্তিষ্কে  আপনার মনন আর চিন্তাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হচ্ছেন না, সেখানে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের কঠিন মুহূর্তে আপনি শাহাদাহ্ দিতে সমর্থ হবেন?
  • কিংবা কোন গান কিংবা সঙ্গীতের মুর্ছনা যখন আপনি মনযোগ সহকারে শুনেন আর তার অস্তিত্ত্ব আর গুন্জন আপনার মস্তিষ্কে রয়ে যায় দীর্ঘক্ষণ কিংবা দীর্ঘদিন। এবার ভাবুন তো, সচল মস্তিষ্ক যেখানে এ ধরনের গুন্জনকে বাধা দিতে সমর্থ নয় কিংবা অবচেতন মনকে তা গ্রাস করে রাখে সেখানে কিভাবে আপনি মৃত্যুর পূর্বক্ষণে শাহাদাহ্ দিতে সমর্থ হবেন?
  • ইমাম আয-যাহাবী তার কিতাবুল কাবায়ের গ্রন্থে এরকম কিছু মৃত্যুর প্রসঙ্গ টেনেছেন যার পরিণতি ছিলো মন্দ। আর এমন পরিণতির কারন তাদের ধারাবাহিক পাপাচারে নিমজ্জিত থাকা। এরূপ একব্যক্তি যার ছিলো এক মহিলা গায়িকার গানের প্রতি আসক্তি। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যখন ঐ ব্যক্তি লড়ছিলেন তখন তার ঘরে ঐ মহিলা গায়িকার গান বাজছিল। এ সময়ে একজন শায়খ তার ঘরে উপনীত হয়ে বলেন এসব বন্ধ করে কুর'আন তিলাওয়াত দেয়ার জন্য কিন্তু তখন ঐ ব্যক্তি বলে উঠল তার এসব সহ্য হয় না। সে ঐ মহিলা গায়িকার গানেই শান্তি পায়। এবার বুঝুন তার পরিণতি।
গান-বাজনার প্রকৃত স্বরূপ:
  • আমি এখনো গান হালাল কি হারাম সে প্রসঙ্গ টানছি না। শুধু এটুকু চিন্তা করুন যেখানে গান-বাজনা হয় সেখানকার পরিবেশের কথা। সেখানে থাকে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, সেখানে থাকে মদ কিংবা নেশাজাতীয় দ্রব্যের সহজলভ্যতা, সেখানে থাকে অশ্লীলতা-অভব্যতার ছড়াছড়ি।  এবার আপনিই ভাবুন ঐখানকার পরিবেশ কি আপনাকে আল্লাহ্'র নৈকট্য লাভে সাহায্য করবে নাকি সীমালঙ্গনে?
  • কিংবা গানে কি আপনি কখনো শুনেছেন নৈতিকতার কথা, ছ্বলাত আদায়ের তাগিদ কিংবা পিতা-মাতার আদেশ মান্য করার হুকুম। না এসব কখনোই আপনি গানে শুনবেন না। এখানে শুনবেন অবৈধ প্রেম কিংবা সম্পর্কের কথা, আত্মম্ভরিতার কথা, হতাশার স্মৃতিচারণ কিংবা সুললিত নারীকন্ঠে যিনা'র [ব্যভিচার] আহবান।
  • এখানে আপনি শুনবেন LP'র 'Crawling in my skin...these wounds they'll not heal'। আর এ গান তো আপনাকে heal করবেই না বরং wounds কে scar বানিয়ে আপনাকে hell এ পাঠাবে। কিংবা Snoop-Dogg'র হেলমেট পরিহিত অবস্থায় গালাগালি। কোন সুস্থ মানুষ কি এরূপ কোন হেলমেট পড়ুয়া ব্যক্তির উপদেশ গ্রহণ করবে? নিশ্চয়ই না। কিংবা Akon এর আত্মম্ভরিতা 'Me..me...and me' এ জাতীয় কথাবার্তা যেখানে কেবল প্রবৃত্তিরই জয়গান করা হয় কিংবা কোন নারীর কন্ঠকে শয়তানের স্বরমিশ্রিত করে কুপ্রস্তাবনার দিকে আহবান।
  • সঙ্গীত-তারকাদের দুর্দশার কথা না বলে কেবল যদি তাদের মধ্যে আত্মহত্যাকারীদের তালিকা করা হয় তা অনেক দীর্ঘ হবে। সঙ্গীতের নামে কপটতা, অপরের দুঃখের ফিরিস্তি, আত্ম-গরিমা আর হতাশার বিকিকিনি কেবল সাময়িক মোহ তৈরী করে; যা জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ভুলিয়ে রাখে। সঙ্গীত তারকাদের পাঁচ মিনিটের মিউজিক ভিডিও কিংবা ষাট মিনিটের আলব্যামে আপনি যা শুনেন আর দেখেন তার সাথে তাদের বাস্তবজীবনের সংযোগ সামান্যই। মূলতঃ তারা মিউজিক ইন্ড্রাস্টি আর দুরাচারী জীবনেরই দাসত্ব করছে।

গান-বাজনার কুফল: 

পূর্ববর্তী সালাফদের অধিকাংশই এ ব্যাপারে একমত ছিলেন যে গান আর কুর'আন একই অন্তরে থাকতে পারে না। এ ব্যাপারে ইবনে তাইমিয়াহ্'র সুস্পষ্ট উক্তি রয়েছে। তারা গানকে বিভিন্ন মন্দ নামে আর গায়ককে বিভিন্ন মন্দ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। যেমন এক সালাফ বলেছেন: "গান হচ্ছে যিনা'র রুকইয়া" অর্থ্যাৎ গান-বাজনা ব্যভিচারের ইন্ধন প্রদানকারী।

আর গান মানুষের অন্তরে সৃষ্টি করে কপটতা কিংবা নিফাক। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
  الْغِنَاءُ يُنْبِتُ النِّفَاقَ فِى الْقَلْبِ كَمَا يُنْبِتُ الْمَاءُ الزَّرْعَ

‘পানি যেমন (ভূমিতে) তৃণলতা উৎপন্ন করে তেমনি গান মানুষের অন্তরে নিফাক সৃষ্টি করে।’[বাইহাকী : ২১৫৩৬; ইগাছাতুল লাহফান ১/১৯৩; তাফসীরে কুরতুবী ১৪/৫২]

সাহাবী ও তাবেয়ীদের ভাষ্য অনুযায়ী গান ও বাদ্যযন্ত্র বহু গুনাহর সমষ্টি। যেমন : ক. নিফাক বা মুনাফেকির উৎস খ. ব্যভিচারে অনুপ্রাণিতকারী গ. মস্তিষ্কের ওপর আবরণ ঘ. কুরআনের প্রতি অনীহা সৃষ্টিকারী ঙ. আখিরাতের চিন্তা নির্মূলকারী চ. গুনাহের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টিকারী ও ছ. জিহাদি চেতনা বিনষ্টকারী। [ইগাছাতুল লাহফান ১/১৮৭]


কুরআন আর সুন্নাহ্'য় গানের বিধান:

আসলে গান-বাজনার ক্ষতিকারিতা এত বেশি যে তা নাজায়েয হওয়ার জন্য আলাদা কোনো প্রমাণের দরকার পড়ে না। তদুপরি মহান আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বহু ভাষ্য থেকে তা হারাম হওয়া প্রমাণিত। যেমন : আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন:

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ

‘আর মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বেহুদা কথা খরিদ করে, আর তারা ঐগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে; তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব।’[সূরা লুকমান, আয়াত : ০৬]

গান-গায়িকা এবং এর ব্যবসা ও চর্চাকে হারাম আখ্যায়িত করে তিনি বলেন:

لاَ تَبِيعُوا الْقَيْنَاتِ وَلاَ تَشْتَرُوهُنَّ وَلاَ تُعَلِّمُوهُنَّ وَلاَ خَيْرَ فِى تِجَارَةٍ فِيهِنَّ وَثَمَنُهُنَّ حَرَامٌ

‘তোমরা গায়িকা (দাসী) কেনাবেচা করো না এবং তাদেরকে গান শিক্ষা দিও না। আর এসবের ব্যবসায় কোনো কল্যাণও নেই। জেনে রেখ, এ থেকে প্রাপ্ত মূল্য হারাম।’ [তিরমিযী : ১৩২৯; ইবন মাজা : ২১৬৮] 

অন্যত্র তিনি বলেন:

لَيَشْرَبَنَّ أُنَاسٌ مِنْ أُمَّتِى الْخَمْرَ يُسَمُّونَهَا بِغَيْرِ اسْمِهَا وَتُضْرَبُ عَلَى رُءُوسِهِمُ الْمَعَازِفُ يَخْسِفُ اللَّهُ بِهِمُ الأَرْضَ وَيَجْعَلُ مِنْهُمْ قِرَدَةً وَخَنَازِيرَ ».

‘আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। আর তাদের মাথার ওপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা নারীদের গান বাজতে থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে মাটিতে ধ্বসিয়ে দেবেন। এবং তাদের মধ্যে অনেককে শূকর ও বাঁদর বানিয়ে দেবেন।’[বাইহাকী, সুনান : ১৭৮৪৫; ইবন মাজা : ৪০২০; ইবন হিব্বান : ৬৭৫৮]

তিনি আরও বলেন:

لَيَكُونَنَّ مِنْ أُمَّتِي أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّونَ الْحِرَ وَالْحَرِيرَ وَالْخَمْرَ وَالْمَعَازِفَ

‘আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোক সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশম, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল সাব্যস্ত করবে।’[বুখারী : ৫৫৯০]

আরেক জায়গায় তিনি বলেন:

بَعَثَنِي اللهُ رَحْمَةً وَهَدًى لِلْعَالَمِينَ وَبَعَثَنِي لِمَحْقِ الْمَعَازِفِ وَالْمَزَامِيرِ، وَأَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ

‘আল্লাহ তা‘আলা আমাকে মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন এবং বাদ্যযন্ত্র, ক্রুশ ও জাহেলি প্রথা অবলুপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন।’[মুসনাদ আহমদ : ২২৩৬১ ; বাইহাকী : ৬১০৪]

চার ইমামের ভাষ্য:

গান ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-অভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। সকলেই গান-বাদ্যকে হারাম বলে আখ্যায়িত করেছেন।

ইমাম মালেক রাহ. কে গান-বাদ্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, কেবল ফাসিকরাই তা করতে পারে। [কুরতুবী ১৪/৫৫]
ইমাম শাফেয়ী রাহ. বলেছেন যে, গান-বাদ্যে লিপ্ত ব্যক্তি হল আহমক।তিনি আরো বলেন, সর্বপ্রকার বীণা, তন্ত্রী, ঢাকঢোল, তবলা, সারেঙ্গী সবই হারাম এবং এর শ্রোতা ফাসেক। তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে না। [ইগাছাতুল লাহফান ১/১৭৯; কুরতুবী ১৪/৫৫]

হাম্বলী মাযহাবের প্রখ্যাত ফকীহ আল্লামা আলী মারদভী লেখেন, বাদ্য ছাড়া গান মাকরূহে তাহরীমী। আর যদি বাদ্য থাকে তবে তা হারাম। [আহসানুল ফাতাওয়া ৮/৩৮৮]

ইমাম শাফেয়ী রাহ. শর্তসাপেক্ষে শুধু ওলীমা অনুষ্ঠানে দফ বাজানোর অবকাশ আছে বলে মত দিয়েছেন। কেননা বিয়ের ঘোষণার উদ্দেশ্যে ওলীমার অনুষ্ঠানে দফ বাজানোর অবকাশের বর্ণনা হাদীসে রয়েছে।-জামে তিরমিযী হাদীস : ১০৮৯; সহীহ বুখারী হাদীস : ৫১৪৭, ৫১৬২ মনে রাখতে হবে, এখানে দফ বাজানোর উদ্দেশ্য হল বিবাহের ঘোষণা, অন্য কিছু নয়। [ফাতহুল বারী ৯/২২৬]

শেষকথা:

গান-বাজনার কুফল নিয়ে আলোচনার ব্যাপক অবকাশ রয়েছে। এখানে এর স্বরূপ, কুফল আর শরীয়াহ্'র দলিলসমূহ পেশ করা হলো। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সত্য উন্মোচিত হওয়ার পর তার অনুসরন করব নাকি প্রবৃত্তির অনুসরন করবো?

[মুল ভাবনা:ভাই কামাল এল-মাক্কী'র লেকচার  'The End of Music']

শুবুহাত [সন্দেহ] আর শাহওয়াহ্ [কুপ্রবৃত্তি] এর ফিতনাহ্- মূল: ইবনুল কায়্যিম

[লিখাটি খানিক দীর্ঘ; ধৈর্যসহকারে পড়ার অনুরোধ]

بسم الله الرحمن الرحيم


শুবুহাত [সন্দেহ]’র ফিতনাহ্:

ফিতনাহ্ দুই প্রকার: শুবুহাত [সন্দেহ]’র ফিতনাহ্, যা দুই ফিতনাহ্’র মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভয়াবহ যার অপরটি শাহওয়াতের [কুপ্রবৃত্তি] ফিতনাহ। এটা খুবই সম্ভব যে এই দুই ফিতনাহ্ একজন আবদের [বান্দা] মধ্যে একইসাথে উপস্থিত থাকতে পারে অথবা এর যে কোন একটি অন্যটির উপস্থিত ব্যতিরেকে।

শুবুহাতের ফিতনাহ মূলতঃ দুর্বল অন্তর্দৃষ্টি আর জ্ঞানের অপ্রতুলতার কারনে হয়। আর এর সাথে যদি যুক্ত হয় মন্দ উদ্দেশ্য আর নিজের কামনা চরিতার্থ করা; এর মধ্যে লুকায়িত রয়েছে ভয়াবহতম বিশৃংখলা আর মন্দতম বিপর্যয়। আপনি এই ধরনের পদস্খলনের মন্দ অভিপ্রায়কে যাই বলুন এর মূলে রয়েছে এরূপ ব্যক্তির প্রবৃত্তির অনুসরন; হুদা [পথনির্দেশিকা]’র নয়, সাথে তার দুর্বল অন্তর্দৃষ্টি আর অপ্রতুল জ্ঞান তার সম্বন্ধে: যা রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়ে এসেছেন। মূলতঃ সে ব্যক্তি তার ন্যায় যার সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

“এগুলো কতগুলো নাম বৈ নয়, যা তোমরা এবং তোমাদের পূর্ব-পুরুষদের রেখেছ। এর সমর্থনে আল্লাহ কোন দলীল নাযিল করেননি। তারা অনুমান এবং প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে। অথচ তাদের কাছে তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে পথ নির্দেশ এসেছে।“ [সুরা নাজম: ২৩]


আর নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের জানিয়েছেন যে প্রবৃত্তির অনুসরণ যে কাউকে আল্লাহ্’র পথ হতে সরিয়ে দেয়। আল্লাহ্ আজ্জা ওয়া’জাল বলেন:

“হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, অতএব, তুমি মানুষের মাঝে ন্যায়সঙ্গতভাবে রাজত্ব কর এবং খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না। তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দেবে। নিশ্চয় যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি, এ কারণে যে, তারা হিসাবদিবসকে ভূলে যায়।“ [সুরা ছোয়াদ: ২৬]

[ইগাছাতুল লাহফান ফি মাসায়্যিদুশ শায়তান - ইবনুল কায়্যিম, ভলিউম: ০২, পৃষ্ঠা ২৩৯-২৪২ এর সারসংক্ষেপ]

এই ধরনের ফিতনাহ্ কুফর [অবিশ্বাস] আর নিফাকের [কপটতা] দিকে ধাবিত করে। এই ধরনের ফিতনাহ্ হচ্ছে মুনাফিক আর আহলুল বিদ’আহ্’দের; তাদের বিদ’আহ্’র মাত্রা অনুযায়ী তা হয়। এভাবে, তাদের অধিকাংশই নতুন বিষয় উদ্ভাবন করে শুবুহাতের ফিতনাহ্’র কারনে; যেখানে তারা সত্যের সাথে মিথ্যার মিশ্রণ ঘটায় আর হিদায়া্হ্’র সাথে ভ্রান্তির।


এই ধরনের ফিতনাহ্’র পঙ্কিলতা থেকে মুক্তির আর কোন উপায় নেই; রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ ব্যতীত। তাকে (আলাইহিস সালাম) সমস্ত সুক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ দ্বীনি বিষয়সমুহের পাশাপাশি সহজ বিষয়সমুহ, তার জীবনের প্রকাশ্য আর গোপনীয় ক্ষেত্রসমুহ, তার বিশ্বাস আর কর্মসমুহ, তার বাস্তবতা আর বিধানসমুহের ক্ষেত্রে মানদন্ড হিসেবে নিযুক্ত করে; এভাবে সে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে ঈমানের স্বরূপ আর ইসলামের বিধানসমুহ গ্রহণ করে। সে তার (আলাইহিস সালাম) কাছ থেকে আরো গ্রহণ করে, যা (আলাইহিস সালাম) তিনি আল্লাহ্’র নাম, গুণাবলী আর কর্মসমুহ সম্পর্কে নিশ্চিত করেছেন আর সে তা প্রত্যাখান করে না। এভাবে, সে তার (আলাইহিস সালাম) কাছ থেকে গ্রহণ করে ছ্বলাতের বাধ্যবাধকতা, এর সময়সূচী আর দৈনিক ওয়াক্ত, একজন মানুষকে কি পরিমান সম্পদের যাকাহ্ দিতে হবে আর কারা এর প্রাপ্য, ওজু আর গোসলের (জানাবাহ্’র ক্ষেত্রে)বাধ্যবাধকতা, রমাদানে সিয়াম পালনের বা্ধ্যবাধকতা প্রভৃতি। সে তাকে (আলাইহিস সালাম) কেবল একজন রাসূল হিসেবে দ্বীনের কিছু ক্ষেত্রে অনুসরণ করবে অন্যক্ষেত্রসমুহে বাদ দিয়ে; বরং তা নয়, তিনি (আলাইহিস সালাম)উম্মাহ্’র প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণীয় রাসূল: হোক তা জ্ঞানে কিংবা কর্মে। সুতরাং, সে অন্য কিছু গ্রহণ করবে না কিংবা নিবে না; তার (আলাইহিস সালাম) কাছ হতে ব্যতীত। কেননা, সমস্ত হিদায়াহ্’র উৎসরণ তার (আলাইহিস সালাম)কথা এবং কাজে। আর তার (আলাইহিস সালাম) হিদায়াহ্ বহির্ভূত সবকিছুই পথভ্রষ্টতা। আর এই মূলনীতি যখন একজন বান্দার অন্তরে প্রোথিত হয় আর সে নিজেকে সবকিছু থেকে ফিরিয়ে নেয় যা রাসুলুল্লাহ্ আনীত হিদায়াহ্ পরিপন্থী; তখন সে যে কোন ক্ষেত্রে, যে কোন সময় নিরীক্ষাধীন বিষয়কে বিচার করে সে জ্যোতি দ্বারা রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়ে এসেছেন: আর তা যদি তার (আলাইহিস সালাম) আনীত বিধানের সাথে মিলে যায় তবে সে তা গ্রহণ করে। আর তা এই কারনে নয় যে, কোন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি তা বলেছে বরং সে তা গ্রহণ করে কারণ তা সুন্নাহ্’র সাথে মিলে যায় আর তা সুন্নাহ্’বিরোধী হলে সে তা প্রত্যাখান করে; এটি বিবেচনা না করে, তা কার নিকট থেকে এসেছে। আর, এটিই কোন ব্যক্তিকে শুবুহাত থেকে রক্ষা করবে আর তার মধ্যে যদি এই মূলনীতি অনুপস্থিত থাকে তবে সে এই ফিতনাহ্ দ্বারা আক্রান্ত হবে ততোধিক যতটা সে এই মূলনীতিকে উপেক্ষা করে।

এই ফিতনাহ্ কখনো ভুল বোঝা, অযথার্থ তথ্য, সত্য উপস্থিত আর প্রমাণিত থাকার পর ও অসতর্কতার কারণে তা থেকে যথার্থ শিক্ষা নিতে অসমর্থ হওয়া, অথবা কখনো কোন ব্যক্তির নিজের মন্দ উদ্দেশ্য আর তার প্রবৃত্তির অনুসরণের ফলে সে ঐসকল ব্যক্তি যারা অন্তর্দৃষ্টি হারিয়ে অন্ধত্ববরণ করে আর যারা নিজেদের উদ্দেশ্যে মন্দ আশ্রয় নেয়; তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়।

শাহাওয়াহ্ [কুপ্রবৃত্তি]’র ফিতনাহ্:

নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা’আলা নিচের আয়াহ্’য় ঐ সকল ব্যক্তির স্বরূপ উল্লেখ করেছেন, যারা এই দুই ধরনের ফিতনাহ্ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে:

"যেমন করে তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তোমাদের চেয়ে বেশী ছিল শক্তিতে এবং ধন-সম্পদের ও সন্তান-সন্ততির অধিকারীও ছিল বেশী; অতঃপর উপকৃত হয়েছে নিজেদের ভাগের দ্বারা আবার তোমরা ফায়দা উঠিয়েছ তোমাদের ভাগের দ্বারা-যেমন করে তোমাদের পূর্ববর্তীরা ফায়দা উঠিয়েছিল নিজেদের ভাগের দ্বারা। আর তোমরাও বলছ তাদেরই চলন অনুযায়ী। তারা ছিল সে লোক, যাদের আমলসমূহ নিঃশেষিত হয়ে গেছে দুনিয়া ও আখেরাতে। আর তারাই হয়েছে ক্ষতির সম্মুখীন।" [সুরা তওবাহ: ৬৯]

এখানে, আল্লাহ্ তা’আলা উল্লেখ করেছেন আমাদের কাছে, কি হয়েছিলো তাদের অন্তর আর দ্বীনের বিকৃতির ফলে। কেননা, তারা দুনিয়ার ভোগসামগ্রীর মোহগ্রস্থতা আর মিথ্যাচারিতায় জড়িয়ে পড়েছিলো। আর, দ্বীনের বিকৃতি সাধিত হয় মিথ্যাচারিতা আর তাতে জড়িয়ে পড়া কিংবা সেই সকল কর্মে জড়িয়ে পড়া যা সঠিক কর্মপন্থার পরিপন্থী।

প্রথম ফিতনার ক্ষেত্র হলো বিদ’আহ্ আর তার ফলশ্রুতি। আর দ্বিতীয়টি হলো পাপকাজে জড়িয়ে পড়া। প্রথমটি (বিদ’আহ্) হলো শুবুহাতের ফলশ্রুতি আর দ্বিতীয়টি (পাপকাজে জড়িয়ে পড়া) হলো শাহওয়াতের ফলশ্রুতি।

এজন্য সালাফরা বলতেন: “দুই ধরনের লোক হতে সতর্ক হও: ঐ ব্যক্তি যে প্রবৃত্তি অনুসৃত (বিদ’আহকারী) যার প্রবৃত্তি তাকে পথভ্রষ্ট করেছে আর ঐ ব্যক্তি যে দুনিয়াদার (বস্তুবাদী) যাকে দুনিয়া অন্ধ করে দিয়েছে।”

সালাফরা আরো বলতেন: “দুষ্ট জ্ঞানী আর অজ্ঞ উপাসণাকারীর ফিতনাহ্ হতে সতর্ক হও; কেননা তাদের ফিতনাহ্ প্রত্যেক পথভ্রষ্টদের আক্রান্ত করে।”

সকল ফিতনাহ্’র উৎস হলো আল্লাহ্’র বিধানের উপর মতামতকে প্রাধান্য দেয়া, আর বুদ্ধিবৃত্তির উপর প্রবৃত্তিকে প্রাধান্য দেয়া। এভাবে, আমরা দেখি প্রথম ফিতনাহ্’র ভিত্তি শুবুহাত আর দ্বিতীয় ফিতনাহ্’র ভিত্তি হলো শাহ্ওয়াত।

এই দুই ফিতনাহ্’র নিরাময়:

শুবুহাতের ফিতনাহ্’র প্রতিরোধ আর নিরাময় করতে হবে আল-ইয়াকীন (সুনিশ্চিত জ্ঞান)আর শাহওয়াতের ফিতনাহ্ নির্মূল আর সারিয়ে তুলতে হবে আস-সবর (ধৈর্য) দ্বারা। আর এই কারণেই আল্লাহ্ তা’আলা এই দুই গুণাবলীকে তার দ্বীনের নেতৃত্বের প্রয়োজনীয় গুণের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। এজন্যই, আল্লাহ্ আজ্জা ওয়া’জাল বলেন:

“তারা সবর করত বিধায় আমি তাদের মধ্য থেকে নেতা মনোনীত করেছিলাম, যারা আমার আদেশে পথ প্রদর্শন করত। তারা আমার আয়াতসমূহে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিল।“[সুরা সাজদাহ্:২৪]

আর এটাই নির্দেশ করে, ধৈর্য আর সুনিশ্চিত জ্ঞানের মাধ্যমে একজন দ্বীনি নেতৃত্বের যোগ্যতা অর্জন করে। আল্লাহ্ তা’আলা এই দুই বৈশিষ্ঠ্যের সম্মিলন ঘটিয়েছেন সুরা আসরে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

“কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকীদ করে সত্যের এবং তাকীদ করে সবরের।“[সুরা আসর: ০৩]

অতএব, একে অপরকে সৎকাজের আদেশ শুবুহাতকে দূরীভূত করে আর ধৈর্যের উপদেশ পরস্পরকে বিরত রাখে প্রবৃত্তির অনুসরণ হতে। সুতরাং, ধৈর্য আর সুস্হ বুদ্ধিবৃত্তি একজনকে শাহ্ওয়াতের ফিতনাহ্ থেকে নিবৃত্ত রাখে আর পরিচ্ছন্ন অন্তর্দৃষ্টি আর সুনিশ্চিত জ্ঞান তাকে দুরে রাখে শুবুহাতের ফিতনাহ্ হতে এবং আল্লাহ্’র সাহায্যই কাম্য।

[অনূদিত: ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসনুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন]

আত্ম-শৃংখলার পথে

بسم الله الرحمن الرحيم


সকল প্রশংসা আল্লাহ্ তা’আলার,

নিজের দ্বীনি কর্মকান্ডে অপূর্ণতার কথা স্বীকার করা; নিজেকে নিয়মানুবর্তী আর শৃংখলিত করায় প্রথম একটি ধাপ। যে নিজের প্রচেষ্টায় অপূর্ণতা স্বীকার করে, সে নিজের আত্ম-শৃংখলার পথে চলতে শুরু করলো।

এই স্বীকারোক্তি হলো আমাদের নিজেদেরকে শৃংখলিত আর অটল থাকার ক্ষেত্রে একটি উপাদান । আর এ স্বীকারোক্তি দেয়া যেনো আপনাকে আত্ম-শৃংখলা থেকে বিরত না রাখে। কেননা এটা আপনার প্রতি আল্লাহ্’র মমত্ববোধের একটা লক্ষন যে আপনি নিজেকে পরিবর্তন আর উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। যেমন, আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

 “...আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।“ [সুরা রাদ: ১১]

সুতরাং যে আল্লাহ্’র সন্তুষ্টিকল্পে নিজেকে পরিবর্তনের চেষ্টা করে, আল্লাহ্ তাকে পরিবর্তনে সাহায্য করেন।

প্রত্যেক ব্যক্তি এককভাবে তার নিজের জন্য দায়বদ্ধ, এবং এককভাবেই জববদিহিতার সন্মূখীন হবে। যেমন, আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

“নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে কেউ নেই যে, দয়াময় আল্লাহর কাছে দাস হয়ে উপস্থিত হবে না।  তাঁর কাছে তাদের পরিসংখ্যান রয়েছে এবং তিনি তাদেরকে গণনা করে রেখেছেন।কেয়ামতের দিন তাদের সবাই তাঁর কাছে একাকী অবস্থায় আসবে।“ [সুরা মারইয়াম: ৯৩-৯৫]

মানুষ তাকে বলা কল্যাণকর বিষয় দ্বারা উপকৃত হতে পারে না, যদি না এতে তার নিজের সম্পৃক্ততা আর আগ্রহবোধ থাকে। আপনি কি জানেন না, নূহ্ আলাইহিস সালাম আর লুত আলাইহিস সালামের স্ত্রীদের সম্পর্কে, যারা ছিলো দুইজন নবীর গৃহের সদস্যা। চিন্তা করুন, এই নবীরা তাদের স্ত্রীদের সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য কতোটা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন; অথচ কতটুকু হিদায়াহ্ [পথনির্দেশিক] তারা লাভে সমর্থ হয়েছে। কেননা, তাদের পক্ষ হতে নিষ্ঠা অনুপস্থিত ছিলো; এজন্যই তাদের বলা হয়েছিলো:

“...এবং তাদেরকে বলা হলঃ জাহান্নামীদের সাথে জাহান্নামে চলে যাও।“ [সুরা তাহরীম: ১০]

অথচ, ফিরআউনের স্ত্রী, যদিও তিনি ছিলেন একজন চরম সীমালঙ্গনকারীর পরিবারের সদস্যা: আল্লাহ্ তা’আলার এক অনন্য উদাহরণ যারা বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের জন্য; কেননা তিনি নিজেকে করেছিলেন সংযত।


একজন মুসলিম নিম্নোক্ত উপায়ে নিজেকে শৃংখলিত করতে পারে:

১. আল্লাহ্’র ইবাদাহ্ করা, তার সাথে অটুট সম্পর্ক রাখা আর নিজেকে তার কাছে পরিপূর্ণভাবে সমর্পণ করা। আর এটা অর্জিত হয় ইবাদাহ্ ; অবশ্য পালনীয় বিষয়সমুহের প্রতি মনোযোগী হওয়া আর নিজের অন্তরকে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যকিছু থেকে সম্পর্কছেদ করার মাধ্যমে।

২. বেশী বেশী কুর’আন পাঠ করা, তাদাব্বুর (কুরআনের গভীর চিন্তা-ভাবনা) আর তা বুঝার চেষ্টা করা।

৩. উপকারী দ্বীনি বই অধ্যয়ণ করা, যাতে রয়েছে অন্তরের যত্ন আর পরিশুদ্ধির আলোচনা, যেমন- মাদারিজ আস-সালিকীন। সালাফদের জীবনী পাঠ করা আর তাদের মনোভাব আর আচরন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা।

৪. শিক্ষামূলক বিষয়ে অংশগ্রহণ করা : যেমন ক্লাস আর লেকচার।

৫. নিজের সময়ের যথার্থ ব্যবহার করা এবং সময়কে এমন উপকারী কাজে ব্যবহার করা; যা দুনিয়া আর আধ্যাত্মিকতা উভয় ধরনের উন্নতি সাধন করে।

৬. অনুমতিযোগ্য অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে আসক্ত না হওয়া আর তাতে খুব বেশী মনযোগ না দেয়া।

৭. সৎকর্মশীলদের সঙ্গে থাকা আর সৎসঙ্গের সন্ধান করা, যারা সৎকর্মে সহায়তা করবে। কেননা, যারা একাকী থাকে তারা অন্যকে নিজের উপর প্রাধান্য দেয়া, সবর ইত্যাদি গুণাবলী রপ্ত করতে সমর্থ হয় না।

৮. যে ইলম অর্জিত হয়েছে তার উপর আ’মালের প্রচেষ্টা করা।

৯. নিজেকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করা।

১০. আল্লাহ্’র জন্য পর্যাপ্ত কাজ করা হচ্ছে না; এই মর্মে নিজেকে তাগাদা দেয়া। প্রচেষ্টার পাশাপাশি এ কথা মনে রাখতে হবে, প্রচেষ্টা কখনো যথেষ্ট নয়।

১১. শরীয়াহ্’র সীমারেখা অনুযায়ী নিজেকে বিরত কিংবা বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করা।

১২. সবসময় লোকজনের সংশ্রবে না থেকে নিজের জন্য একাকী কিছু সময় বের করা; যাতে ইবাদাহ্ আর আত্মসমালোচনার ফুরসত মিলে।

আল্লাহ্’র কাছেই আমরা সাহায্য প্রার্থনা করি; যাতে আমরা নিজেদের শৃংখলিত আর সংযত করতে পারি আর আল্লাহ্’র কাছে সমর্পণ করতে পারি যেভাবে তিনি সন্তুষ্ট হন আর ভালবাসেন। আল্লাহ্ তা’আলা তার ছ্বলাত আর সালাম বর্ষণ করুন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তার পরিবার আর সাহাবাদের উপর।


[এই স্মরণিকা সবার আগে নিজের জন্য।]
কৃতজ্ঞতা: IslamQA এর একটি প্রশ্নোত্তর