Saturday 25 May 2013

গান-বাজনা: শেষ এখানেই

بسم الله الرحمن الرحيم

প্রারম্ভিক কথা:
  • কোন সুসংবাদ কিংবা দুঃসংবাদ শুনলে আপনার মুখ দিয়ে প্রথমে কি কি শব্দ বেরিয়ে আসে। সুবহান'আল্লহ্, আলহামদুলিল্লাহ্ কিংবা আল্লহু আকবার নাকি একগুচ্ছ ইংরেজী অশ্লীল শব্দগুচ্ছ। একটু খেয়াল করুন, যেখানে আপনি সম্পূর্ণ সচেতন আর সুস্থ মস্তিষ্কে  আপনার মনন আর চিন্তাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হচ্ছেন না, সেখানে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের কঠিন মুহূর্তে আপনি শাহাদাহ্ দিতে সমর্থ হবেন?
  • কিংবা কোন গান কিংবা সঙ্গীতের মুর্ছনা যখন আপনি মনযোগ সহকারে শুনেন আর তার অস্তিত্ত্ব আর গুন্জন আপনার মস্তিষ্কে রয়ে যায় দীর্ঘক্ষণ কিংবা দীর্ঘদিন। এবার ভাবুন তো, সচল মস্তিষ্ক যেখানে এ ধরনের গুন্জনকে বাধা দিতে সমর্থ নয় কিংবা অবচেতন মনকে তা গ্রাস করে রাখে সেখানে কিভাবে আপনি মৃত্যুর পূর্বক্ষণে শাহাদাহ্ দিতে সমর্থ হবেন?
  • ইমাম আয-যাহাবী তার কিতাবুল কাবায়ের গ্রন্থে এরকম কিছু মৃত্যুর প্রসঙ্গ টেনেছেন যার পরিণতি ছিলো মন্দ। আর এমন পরিণতির কারন তাদের ধারাবাহিক পাপাচারে নিমজ্জিত থাকা। এরূপ একব্যক্তি যার ছিলো এক মহিলা গায়িকার গানের প্রতি আসক্তি। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যখন ঐ ব্যক্তি লড়ছিলেন তখন তার ঘরে ঐ মহিলা গায়িকার গান বাজছিল। এ সময়ে একজন শায়খ তার ঘরে উপনীত হয়ে বলেন এসব বন্ধ করে কুর'আন তিলাওয়াত দেয়ার জন্য কিন্তু তখন ঐ ব্যক্তি বলে উঠল তার এসব সহ্য হয় না। সে ঐ মহিলা গায়িকার গানেই শান্তি পায়। এবার বুঝুন তার পরিণতি।
গান-বাজনার প্রকৃত স্বরূপ:
  • আমি এখনো গান হালাল কি হারাম সে প্রসঙ্গ টানছি না। শুধু এটুকু চিন্তা করুন যেখানে গান-বাজনা হয় সেখানকার পরিবেশের কথা। সেখানে থাকে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, সেখানে থাকে মদ কিংবা নেশাজাতীয় দ্রব্যের সহজলভ্যতা, সেখানে থাকে অশ্লীলতা-অভব্যতার ছড়াছড়ি।  এবার আপনিই ভাবুন ঐখানকার পরিবেশ কি আপনাকে আল্লাহ্'র নৈকট্য লাভে সাহায্য করবে নাকি সীমালঙ্গনে?
  • কিংবা গানে কি আপনি কখনো শুনেছেন নৈতিকতার কথা, ছ্বলাত আদায়ের তাগিদ কিংবা পিতা-মাতার আদেশ মান্য করার হুকুম। না এসব কখনোই আপনি গানে শুনবেন না। এখানে শুনবেন অবৈধ প্রেম কিংবা সম্পর্কের কথা, আত্মম্ভরিতার কথা, হতাশার স্মৃতিচারণ কিংবা সুললিত নারীকন্ঠে যিনা'র [ব্যভিচার] আহবান।
  • এখানে আপনি শুনবেন LP'র 'Crawling in my skin...these wounds they'll not heal'। আর এ গান তো আপনাকে heal করবেই না বরং wounds কে scar বানিয়ে আপনাকে hell এ পাঠাবে। কিংবা Snoop-Dogg'র হেলমেট পরিহিত অবস্থায় গালাগালি। কোন সুস্থ মানুষ কি এরূপ কোন হেলমেট পড়ুয়া ব্যক্তির উপদেশ গ্রহণ করবে? নিশ্চয়ই না। কিংবা Akon এর আত্মম্ভরিতা 'Me..me...and me' এ জাতীয় কথাবার্তা যেখানে কেবল প্রবৃত্তিরই জয়গান করা হয় কিংবা কোন নারীর কন্ঠকে শয়তানের স্বরমিশ্রিত করে কুপ্রস্তাবনার দিকে আহবান।
  • সঙ্গীত-তারকাদের দুর্দশার কথা না বলে কেবল যদি তাদের মধ্যে আত্মহত্যাকারীদের তালিকা করা হয় তা অনেক দীর্ঘ হবে। সঙ্গীতের নামে কপটতা, অপরের দুঃখের ফিরিস্তি, আত্ম-গরিমা আর হতাশার বিকিকিনি কেবল সাময়িক মোহ তৈরী করে; যা জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ভুলিয়ে রাখে। সঙ্গীত তারকাদের পাঁচ মিনিটের মিউজিক ভিডিও কিংবা ষাট মিনিটের আলব্যামে আপনি যা শুনেন আর দেখেন তার সাথে তাদের বাস্তবজীবনের সংযোগ সামান্যই। মূলতঃ তারা মিউজিক ইন্ড্রাস্টি আর দুরাচারী জীবনেরই দাসত্ব করছে।

গান-বাজনার কুফল: 

পূর্ববর্তী সালাফদের অধিকাংশই এ ব্যাপারে একমত ছিলেন যে গান আর কুর'আন একই অন্তরে থাকতে পারে না। এ ব্যাপারে ইবনে তাইমিয়াহ্'র সুস্পষ্ট উক্তি রয়েছে। তারা গানকে বিভিন্ন মন্দ নামে আর গায়ককে বিভিন্ন মন্দ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। যেমন এক সালাফ বলেছেন: "গান হচ্ছে যিনা'র রুকইয়া" অর্থ্যাৎ গান-বাজনা ব্যভিচারের ইন্ধন প্রদানকারী।

আর গান মানুষের অন্তরে সৃষ্টি করে কপটতা কিংবা নিফাক। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
  الْغِنَاءُ يُنْبِتُ النِّفَاقَ فِى الْقَلْبِ كَمَا يُنْبِتُ الْمَاءُ الزَّرْعَ

‘পানি যেমন (ভূমিতে) তৃণলতা উৎপন্ন করে তেমনি গান মানুষের অন্তরে নিফাক সৃষ্টি করে।’[বাইহাকী : ২১৫৩৬; ইগাছাতুল লাহফান ১/১৯৩; তাফসীরে কুরতুবী ১৪/৫২]

সাহাবী ও তাবেয়ীদের ভাষ্য অনুযায়ী গান ও বাদ্যযন্ত্র বহু গুনাহর সমষ্টি। যেমন : ক. নিফাক বা মুনাফেকির উৎস খ. ব্যভিচারে অনুপ্রাণিতকারী গ. মস্তিষ্কের ওপর আবরণ ঘ. কুরআনের প্রতি অনীহা সৃষ্টিকারী ঙ. আখিরাতের চিন্তা নির্মূলকারী চ. গুনাহের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টিকারী ও ছ. জিহাদি চেতনা বিনষ্টকারী। [ইগাছাতুল লাহফান ১/১৮৭]


কুরআন আর সুন্নাহ্'য় গানের বিধান:

আসলে গান-বাজনার ক্ষতিকারিতা এত বেশি যে তা নাজায়েয হওয়ার জন্য আলাদা কোনো প্রমাণের দরকার পড়ে না। তদুপরি মহান আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বহু ভাষ্য থেকে তা হারাম হওয়া প্রমাণিত। যেমন : আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন:

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ

‘আর মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বেহুদা কথা খরিদ করে, আর তারা ঐগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে; তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব।’[সূরা লুকমান, আয়াত : ০৬]

গান-গায়িকা এবং এর ব্যবসা ও চর্চাকে হারাম আখ্যায়িত করে তিনি বলেন:

لاَ تَبِيعُوا الْقَيْنَاتِ وَلاَ تَشْتَرُوهُنَّ وَلاَ تُعَلِّمُوهُنَّ وَلاَ خَيْرَ فِى تِجَارَةٍ فِيهِنَّ وَثَمَنُهُنَّ حَرَامٌ

‘তোমরা গায়িকা (দাসী) কেনাবেচা করো না এবং তাদেরকে গান শিক্ষা দিও না। আর এসবের ব্যবসায় কোনো কল্যাণও নেই। জেনে রেখ, এ থেকে প্রাপ্ত মূল্য হারাম।’ [তিরমিযী : ১৩২৯; ইবন মাজা : ২১৬৮] 

অন্যত্র তিনি বলেন:

لَيَشْرَبَنَّ أُنَاسٌ مِنْ أُمَّتِى الْخَمْرَ يُسَمُّونَهَا بِغَيْرِ اسْمِهَا وَتُضْرَبُ عَلَى رُءُوسِهِمُ الْمَعَازِفُ يَخْسِفُ اللَّهُ بِهِمُ الأَرْضَ وَيَجْعَلُ مِنْهُمْ قِرَدَةً وَخَنَازِيرَ ».

‘আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। আর তাদের মাথার ওপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা নারীদের গান বাজতে থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে মাটিতে ধ্বসিয়ে দেবেন। এবং তাদের মধ্যে অনেককে শূকর ও বাঁদর বানিয়ে দেবেন।’[বাইহাকী, সুনান : ১৭৮৪৫; ইবন মাজা : ৪০২০; ইবন হিব্বান : ৬৭৫৮]

তিনি আরও বলেন:

لَيَكُونَنَّ مِنْ أُمَّتِي أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّونَ الْحِرَ وَالْحَرِيرَ وَالْخَمْرَ وَالْمَعَازِفَ

‘আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোক সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশম, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল সাব্যস্ত করবে।’[বুখারী : ৫৫৯০]

আরেক জায়গায় তিনি বলেন:

بَعَثَنِي اللهُ رَحْمَةً وَهَدًى لِلْعَالَمِينَ وَبَعَثَنِي لِمَحْقِ الْمَعَازِفِ وَالْمَزَامِيرِ، وَأَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ

‘আল্লাহ তা‘আলা আমাকে মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন এবং বাদ্যযন্ত্র, ক্রুশ ও জাহেলি প্রথা অবলুপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন।’[মুসনাদ আহমদ : ২২৩৬১ ; বাইহাকী : ৬১০৪]

চার ইমামের ভাষ্য:

গান ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-অভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। সকলেই গান-বাদ্যকে হারাম বলে আখ্যায়িত করেছেন।

ইমাম মালেক রাহ. কে গান-বাদ্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, কেবল ফাসিকরাই তা করতে পারে। [কুরতুবী ১৪/৫৫]
ইমাম শাফেয়ী রাহ. বলেছেন যে, গান-বাদ্যে লিপ্ত ব্যক্তি হল আহমক।তিনি আরো বলেন, সর্বপ্রকার বীণা, তন্ত্রী, ঢাকঢোল, তবলা, সারেঙ্গী সবই হারাম এবং এর শ্রোতা ফাসেক। তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে না। [ইগাছাতুল লাহফান ১/১৭৯; কুরতুবী ১৪/৫৫]

হাম্বলী মাযহাবের প্রখ্যাত ফকীহ আল্লামা আলী মারদভী লেখেন, বাদ্য ছাড়া গান মাকরূহে তাহরীমী। আর যদি বাদ্য থাকে তবে তা হারাম। [আহসানুল ফাতাওয়া ৮/৩৮৮]

ইমাম শাফেয়ী রাহ. শর্তসাপেক্ষে শুধু ওলীমা অনুষ্ঠানে দফ বাজানোর অবকাশ আছে বলে মত দিয়েছেন। কেননা বিয়ের ঘোষণার উদ্দেশ্যে ওলীমার অনুষ্ঠানে দফ বাজানোর অবকাশের বর্ণনা হাদীসে রয়েছে।-জামে তিরমিযী হাদীস : ১০৮৯; সহীহ বুখারী হাদীস : ৫১৪৭, ৫১৬২ মনে রাখতে হবে, এখানে দফ বাজানোর উদ্দেশ্য হল বিবাহের ঘোষণা, অন্য কিছু নয়। [ফাতহুল বারী ৯/২২৬]

শেষকথা:

গান-বাজনার কুফল নিয়ে আলোচনার ব্যাপক অবকাশ রয়েছে। এখানে এর স্বরূপ, কুফল আর শরীয়াহ্'র দলিলসমূহ পেশ করা হলো। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সত্য উন্মোচিত হওয়ার পর তার অনুসরন করব নাকি প্রবৃত্তির অনুসরন করবো?

[মুল ভাবনা:ভাই কামাল এল-মাক্কী'র লেকচার  'The End of Music']

শুবুহাত [সন্দেহ] আর শাহওয়াহ্ [কুপ্রবৃত্তি] এর ফিতনাহ্- মূল: ইবনুল কায়্যিম

[লিখাটি খানিক দীর্ঘ; ধৈর্যসহকারে পড়ার অনুরোধ]

بسم الله الرحمن الرحيم


শুবুহাত [সন্দেহ]’র ফিতনাহ্:

ফিতনাহ্ দুই প্রকার: শুবুহাত [সন্দেহ]’র ফিতনাহ্, যা দুই ফিতনাহ্’র মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভয়াবহ যার অপরটি শাহওয়াতের [কুপ্রবৃত্তি] ফিতনাহ। এটা খুবই সম্ভব যে এই দুই ফিতনাহ্ একজন আবদের [বান্দা] মধ্যে একইসাথে উপস্থিত থাকতে পারে অথবা এর যে কোন একটি অন্যটির উপস্থিত ব্যতিরেকে।

শুবুহাতের ফিতনাহ মূলতঃ দুর্বল অন্তর্দৃষ্টি আর জ্ঞানের অপ্রতুলতার কারনে হয়। আর এর সাথে যদি যুক্ত হয় মন্দ উদ্দেশ্য আর নিজের কামনা চরিতার্থ করা; এর মধ্যে লুকায়িত রয়েছে ভয়াবহতম বিশৃংখলা আর মন্দতম বিপর্যয়। আপনি এই ধরনের পদস্খলনের মন্দ অভিপ্রায়কে যাই বলুন এর মূলে রয়েছে এরূপ ব্যক্তির প্রবৃত্তির অনুসরন; হুদা [পথনির্দেশিকা]’র নয়, সাথে তার দুর্বল অন্তর্দৃষ্টি আর অপ্রতুল জ্ঞান তার সম্বন্ধে: যা রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়ে এসেছেন। মূলতঃ সে ব্যক্তি তার ন্যায় যার সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

“এগুলো কতগুলো নাম বৈ নয়, যা তোমরা এবং তোমাদের পূর্ব-পুরুষদের রেখেছ। এর সমর্থনে আল্লাহ কোন দলীল নাযিল করেননি। তারা অনুমান এবং প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে। অথচ তাদের কাছে তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে পথ নির্দেশ এসেছে।“ [সুরা নাজম: ২৩]


আর নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের জানিয়েছেন যে প্রবৃত্তির অনুসরণ যে কাউকে আল্লাহ্’র পথ হতে সরিয়ে দেয়। আল্লাহ্ আজ্জা ওয়া’জাল বলেন:

“হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, অতএব, তুমি মানুষের মাঝে ন্যায়সঙ্গতভাবে রাজত্ব কর এবং খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না। তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দেবে। নিশ্চয় যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি, এ কারণে যে, তারা হিসাবদিবসকে ভূলে যায়।“ [সুরা ছোয়াদ: ২৬]

[ইগাছাতুল লাহফান ফি মাসায়্যিদুশ শায়তান - ইবনুল কায়্যিম, ভলিউম: ০২, পৃষ্ঠা ২৩৯-২৪২ এর সারসংক্ষেপ]

এই ধরনের ফিতনাহ্ কুফর [অবিশ্বাস] আর নিফাকের [কপটতা] দিকে ধাবিত করে। এই ধরনের ফিতনাহ্ হচ্ছে মুনাফিক আর আহলুল বিদ’আহ্’দের; তাদের বিদ’আহ্’র মাত্রা অনুযায়ী তা হয়। এভাবে, তাদের অধিকাংশই নতুন বিষয় উদ্ভাবন করে শুবুহাতের ফিতনাহ্’র কারনে; যেখানে তারা সত্যের সাথে মিথ্যার মিশ্রণ ঘটায় আর হিদায়া্হ্’র সাথে ভ্রান্তির।


এই ধরনের ফিতনাহ্’র পঙ্কিলতা থেকে মুক্তির আর কোন উপায় নেই; রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ ব্যতীত। তাকে (আলাইহিস সালাম) সমস্ত সুক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ দ্বীনি বিষয়সমুহের পাশাপাশি সহজ বিষয়সমুহ, তার জীবনের প্রকাশ্য আর গোপনীয় ক্ষেত্রসমুহ, তার বিশ্বাস আর কর্মসমুহ, তার বাস্তবতা আর বিধানসমুহের ক্ষেত্রে মানদন্ড হিসেবে নিযুক্ত করে; এভাবে সে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে ঈমানের স্বরূপ আর ইসলামের বিধানসমুহ গ্রহণ করে। সে তার (আলাইহিস সালাম) কাছ থেকে আরো গ্রহণ করে, যা (আলাইহিস সালাম) তিনি আল্লাহ্’র নাম, গুণাবলী আর কর্মসমুহ সম্পর্কে নিশ্চিত করেছেন আর সে তা প্রত্যাখান করে না। এভাবে, সে তার (আলাইহিস সালাম) কাছ থেকে গ্রহণ করে ছ্বলাতের বাধ্যবাধকতা, এর সময়সূচী আর দৈনিক ওয়াক্ত, একজন মানুষকে কি পরিমান সম্পদের যাকাহ্ দিতে হবে আর কারা এর প্রাপ্য, ওজু আর গোসলের (জানাবাহ্’র ক্ষেত্রে)বাধ্যবাধকতা, রমাদানে সিয়াম পালনের বা্ধ্যবাধকতা প্রভৃতি। সে তাকে (আলাইহিস সালাম) কেবল একজন রাসূল হিসেবে দ্বীনের কিছু ক্ষেত্রে অনুসরণ করবে অন্যক্ষেত্রসমুহে বাদ দিয়ে; বরং তা নয়, তিনি (আলাইহিস সালাম)উম্মাহ্’র প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণীয় রাসূল: হোক তা জ্ঞানে কিংবা কর্মে। সুতরাং, সে অন্য কিছু গ্রহণ করবে না কিংবা নিবে না; তার (আলাইহিস সালাম) কাছ হতে ব্যতীত। কেননা, সমস্ত হিদায়াহ্’র উৎসরণ তার (আলাইহিস সালাম)কথা এবং কাজে। আর তার (আলাইহিস সালাম) হিদায়াহ্ বহির্ভূত সবকিছুই পথভ্রষ্টতা। আর এই মূলনীতি যখন একজন বান্দার অন্তরে প্রোথিত হয় আর সে নিজেকে সবকিছু থেকে ফিরিয়ে নেয় যা রাসুলুল্লাহ্ আনীত হিদায়াহ্ পরিপন্থী; তখন সে যে কোন ক্ষেত্রে, যে কোন সময় নিরীক্ষাধীন বিষয়কে বিচার করে সে জ্যোতি দ্বারা রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়ে এসেছেন: আর তা যদি তার (আলাইহিস সালাম) আনীত বিধানের সাথে মিলে যায় তবে সে তা গ্রহণ করে। আর তা এই কারনে নয় যে, কোন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি তা বলেছে বরং সে তা গ্রহণ করে কারণ তা সুন্নাহ্’র সাথে মিলে যায় আর তা সুন্নাহ্’বিরোধী হলে সে তা প্রত্যাখান করে; এটি বিবেচনা না করে, তা কার নিকট থেকে এসেছে। আর, এটিই কোন ব্যক্তিকে শুবুহাত থেকে রক্ষা করবে আর তার মধ্যে যদি এই মূলনীতি অনুপস্থিত থাকে তবে সে এই ফিতনাহ্ দ্বারা আক্রান্ত হবে ততোধিক যতটা সে এই মূলনীতিকে উপেক্ষা করে।

এই ফিতনাহ্ কখনো ভুল বোঝা, অযথার্থ তথ্য, সত্য উপস্থিত আর প্রমাণিত থাকার পর ও অসতর্কতার কারণে তা থেকে যথার্থ শিক্ষা নিতে অসমর্থ হওয়া, অথবা কখনো কোন ব্যক্তির নিজের মন্দ উদ্দেশ্য আর তার প্রবৃত্তির অনুসরণের ফলে সে ঐসকল ব্যক্তি যারা অন্তর্দৃষ্টি হারিয়ে অন্ধত্ববরণ করে আর যারা নিজেদের উদ্দেশ্যে মন্দ আশ্রয় নেয়; তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়।

শাহাওয়াহ্ [কুপ্রবৃত্তি]’র ফিতনাহ্:

নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা’আলা নিচের আয়াহ্’য় ঐ সকল ব্যক্তির স্বরূপ উল্লেখ করেছেন, যারা এই দুই ধরনের ফিতনাহ্ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে:

"যেমন করে তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তোমাদের চেয়ে বেশী ছিল শক্তিতে এবং ধন-সম্পদের ও সন্তান-সন্ততির অধিকারীও ছিল বেশী; অতঃপর উপকৃত হয়েছে নিজেদের ভাগের দ্বারা আবার তোমরা ফায়দা উঠিয়েছ তোমাদের ভাগের দ্বারা-যেমন করে তোমাদের পূর্ববর্তীরা ফায়দা উঠিয়েছিল নিজেদের ভাগের দ্বারা। আর তোমরাও বলছ তাদেরই চলন অনুযায়ী। তারা ছিল সে লোক, যাদের আমলসমূহ নিঃশেষিত হয়ে গেছে দুনিয়া ও আখেরাতে। আর তারাই হয়েছে ক্ষতির সম্মুখীন।" [সুরা তওবাহ: ৬৯]

এখানে, আল্লাহ্ তা’আলা উল্লেখ করেছেন আমাদের কাছে, কি হয়েছিলো তাদের অন্তর আর দ্বীনের বিকৃতির ফলে। কেননা, তারা দুনিয়ার ভোগসামগ্রীর মোহগ্রস্থতা আর মিথ্যাচারিতায় জড়িয়ে পড়েছিলো। আর, দ্বীনের বিকৃতি সাধিত হয় মিথ্যাচারিতা আর তাতে জড়িয়ে পড়া কিংবা সেই সকল কর্মে জড়িয়ে পড়া যা সঠিক কর্মপন্থার পরিপন্থী।

প্রথম ফিতনার ক্ষেত্র হলো বিদ’আহ্ আর তার ফলশ্রুতি। আর দ্বিতীয়টি হলো পাপকাজে জড়িয়ে পড়া। প্রথমটি (বিদ’আহ্) হলো শুবুহাতের ফলশ্রুতি আর দ্বিতীয়টি (পাপকাজে জড়িয়ে পড়া) হলো শাহওয়াতের ফলশ্রুতি।

এজন্য সালাফরা বলতেন: “দুই ধরনের লোক হতে সতর্ক হও: ঐ ব্যক্তি যে প্রবৃত্তি অনুসৃত (বিদ’আহকারী) যার প্রবৃত্তি তাকে পথভ্রষ্ট করেছে আর ঐ ব্যক্তি যে দুনিয়াদার (বস্তুবাদী) যাকে দুনিয়া অন্ধ করে দিয়েছে।”

সালাফরা আরো বলতেন: “দুষ্ট জ্ঞানী আর অজ্ঞ উপাসণাকারীর ফিতনাহ্ হতে সতর্ক হও; কেননা তাদের ফিতনাহ্ প্রত্যেক পথভ্রষ্টদের আক্রান্ত করে।”

সকল ফিতনাহ্’র উৎস হলো আল্লাহ্’র বিধানের উপর মতামতকে প্রাধান্য দেয়া, আর বুদ্ধিবৃত্তির উপর প্রবৃত্তিকে প্রাধান্য দেয়া। এভাবে, আমরা দেখি প্রথম ফিতনাহ্’র ভিত্তি শুবুহাত আর দ্বিতীয় ফিতনাহ্’র ভিত্তি হলো শাহ্ওয়াত।

এই দুই ফিতনাহ্’র নিরাময়:

শুবুহাতের ফিতনাহ্’র প্রতিরোধ আর নিরাময় করতে হবে আল-ইয়াকীন (সুনিশ্চিত জ্ঞান)আর শাহওয়াতের ফিতনাহ্ নির্মূল আর সারিয়ে তুলতে হবে আস-সবর (ধৈর্য) দ্বারা। আর এই কারণেই আল্লাহ্ তা’আলা এই দুই গুণাবলীকে তার দ্বীনের নেতৃত্বের প্রয়োজনীয় গুণের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। এজন্যই, আল্লাহ্ আজ্জা ওয়া’জাল বলেন:

“তারা সবর করত বিধায় আমি তাদের মধ্য থেকে নেতা মনোনীত করেছিলাম, যারা আমার আদেশে পথ প্রদর্শন করত। তারা আমার আয়াতসমূহে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিল।“[সুরা সাজদাহ্:২৪]

আর এটাই নির্দেশ করে, ধৈর্য আর সুনিশ্চিত জ্ঞানের মাধ্যমে একজন দ্বীনি নেতৃত্বের যোগ্যতা অর্জন করে। আল্লাহ্ তা’আলা এই দুই বৈশিষ্ঠ্যের সম্মিলন ঘটিয়েছেন সুরা আসরে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

“কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকীদ করে সত্যের এবং তাকীদ করে সবরের।“[সুরা আসর: ০৩]

অতএব, একে অপরকে সৎকাজের আদেশ শুবুহাতকে দূরীভূত করে আর ধৈর্যের উপদেশ পরস্পরকে বিরত রাখে প্রবৃত্তির অনুসরণ হতে। সুতরাং, ধৈর্য আর সুস্হ বুদ্ধিবৃত্তি একজনকে শাহ্ওয়াতের ফিতনাহ্ থেকে নিবৃত্ত রাখে আর পরিচ্ছন্ন অন্তর্দৃষ্টি আর সুনিশ্চিত জ্ঞান তাকে দুরে রাখে শুবুহাতের ফিতনাহ্ হতে এবং আল্লাহ্’র সাহায্যই কাম্য।

[অনূদিত: ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসনুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন]

আত্ম-শৃংখলার পথে

بسم الله الرحمن الرحيم


সকল প্রশংসা আল্লাহ্ তা’আলার,

নিজের দ্বীনি কর্মকান্ডে অপূর্ণতার কথা স্বীকার করা; নিজেকে নিয়মানুবর্তী আর শৃংখলিত করায় প্রথম একটি ধাপ। যে নিজের প্রচেষ্টায় অপূর্ণতা স্বীকার করে, সে নিজের আত্ম-শৃংখলার পথে চলতে শুরু করলো।

এই স্বীকারোক্তি হলো আমাদের নিজেদেরকে শৃংখলিত আর অটল থাকার ক্ষেত্রে একটি উপাদান । আর এ স্বীকারোক্তি দেয়া যেনো আপনাকে আত্ম-শৃংখলা থেকে বিরত না রাখে। কেননা এটা আপনার প্রতি আল্লাহ্’র মমত্ববোধের একটা লক্ষন যে আপনি নিজেকে পরিবর্তন আর উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। যেমন, আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

 “...আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।“ [সুরা রাদ: ১১]

সুতরাং যে আল্লাহ্’র সন্তুষ্টিকল্পে নিজেকে পরিবর্তনের চেষ্টা করে, আল্লাহ্ তাকে পরিবর্তনে সাহায্য করেন।

প্রত্যেক ব্যক্তি এককভাবে তার নিজের জন্য দায়বদ্ধ, এবং এককভাবেই জববদিহিতার সন্মূখীন হবে। যেমন, আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

“নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে কেউ নেই যে, দয়াময় আল্লাহর কাছে দাস হয়ে উপস্থিত হবে না।  তাঁর কাছে তাদের পরিসংখ্যান রয়েছে এবং তিনি তাদেরকে গণনা করে রেখেছেন।কেয়ামতের দিন তাদের সবাই তাঁর কাছে একাকী অবস্থায় আসবে।“ [সুরা মারইয়াম: ৯৩-৯৫]

মানুষ তাকে বলা কল্যাণকর বিষয় দ্বারা উপকৃত হতে পারে না, যদি না এতে তার নিজের সম্পৃক্ততা আর আগ্রহবোধ থাকে। আপনি কি জানেন না, নূহ্ আলাইহিস সালাম আর লুত আলাইহিস সালামের স্ত্রীদের সম্পর্কে, যারা ছিলো দুইজন নবীর গৃহের সদস্যা। চিন্তা করুন, এই নবীরা তাদের স্ত্রীদের সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য কতোটা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন; অথচ কতটুকু হিদায়াহ্ [পথনির্দেশিক] তারা লাভে সমর্থ হয়েছে। কেননা, তাদের পক্ষ হতে নিষ্ঠা অনুপস্থিত ছিলো; এজন্যই তাদের বলা হয়েছিলো:

“...এবং তাদেরকে বলা হলঃ জাহান্নামীদের সাথে জাহান্নামে চলে যাও।“ [সুরা তাহরীম: ১০]

অথচ, ফিরআউনের স্ত্রী, যদিও তিনি ছিলেন একজন চরম সীমালঙ্গনকারীর পরিবারের সদস্যা: আল্লাহ্ তা’আলার এক অনন্য উদাহরণ যারা বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের জন্য; কেননা তিনি নিজেকে করেছিলেন সংযত।


একজন মুসলিম নিম্নোক্ত উপায়ে নিজেকে শৃংখলিত করতে পারে:

১. আল্লাহ্’র ইবাদাহ্ করা, তার সাথে অটুট সম্পর্ক রাখা আর নিজেকে তার কাছে পরিপূর্ণভাবে সমর্পণ করা। আর এটা অর্জিত হয় ইবাদাহ্ ; অবশ্য পালনীয় বিষয়সমুহের প্রতি মনোযোগী হওয়া আর নিজের অন্তরকে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যকিছু থেকে সম্পর্কছেদ করার মাধ্যমে।

২. বেশী বেশী কুর’আন পাঠ করা, তাদাব্বুর (কুরআনের গভীর চিন্তা-ভাবনা) আর তা বুঝার চেষ্টা করা।

৩. উপকারী দ্বীনি বই অধ্যয়ণ করা, যাতে রয়েছে অন্তরের যত্ন আর পরিশুদ্ধির আলোচনা, যেমন- মাদারিজ আস-সালিকীন। সালাফদের জীবনী পাঠ করা আর তাদের মনোভাব আর আচরন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা।

৪. শিক্ষামূলক বিষয়ে অংশগ্রহণ করা : যেমন ক্লাস আর লেকচার।

৫. নিজের সময়ের যথার্থ ব্যবহার করা এবং সময়কে এমন উপকারী কাজে ব্যবহার করা; যা দুনিয়া আর আধ্যাত্মিকতা উভয় ধরনের উন্নতি সাধন করে।

৬. অনুমতিযোগ্য অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে আসক্ত না হওয়া আর তাতে খুব বেশী মনযোগ না দেয়া।

৭. সৎকর্মশীলদের সঙ্গে থাকা আর সৎসঙ্গের সন্ধান করা, যারা সৎকর্মে সহায়তা করবে। কেননা, যারা একাকী থাকে তারা অন্যকে নিজের উপর প্রাধান্য দেয়া, সবর ইত্যাদি গুণাবলী রপ্ত করতে সমর্থ হয় না।

৮. যে ইলম অর্জিত হয়েছে তার উপর আ’মালের প্রচেষ্টা করা।

৯. নিজেকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করা।

১০. আল্লাহ্’র জন্য পর্যাপ্ত কাজ করা হচ্ছে না; এই মর্মে নিজেকে তাগাদা দেয়া। প্রচেষ্টার পাশাপাশি এ কথা মনে রাখতে হবে, প্রচেষ্টা কখনো যথেষ্ট নয়।

১১. শরীয়াহ্’র সীমারেখা অনুযায়ী নিজেকে বিরত কিংবা বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করা।

১২. সবসময় লোকজনের সংশ্রবে না থেকে নিজের জন্য একাকী কিছু সময় বের করা; যাতে ইবাদাহ্ আর আত্মসমালোচনার ফুরসত মিলে।

আল্লাহ্’র কাছেই আমরা সাহায্য প্রার্থনা করি; যাতে আমরা নিজেদের শৃংখলিত আর সংযত করতে পারি আর আল্লাহ্’র কাছে সমর্পণ করতে পারি যেভাবে তিনি সন্তুষ্ট হন আর ভালবাসেন। আল্লাহ্ তা’আলা তার ছ্বলাত আর সালাম বর্ষণ করুন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তার পরিবার আর সাহাবাদের উপর।


[এই স্মরণিকা সবার আগে নিজের জন্য।]
কৃতজ্ঞতা: IslamQA এর একটি প্রশ্নোত্তর

বিশ্বাসের একটি ভাষা আছে


بسم الله الرحمن الرحيم
  
পাকিস্তানের একজন ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষক অফিসিয়াল ট্যুরে ভ্যাটিকান গিয়েছিলেন। তারা সেখানে উচ্চতর একদল পাদ্রীর সাথে সাক্ষাত করেছিলেন।

ওই শিক্ষক একজন পাদ্রীকে জিজ্ঞেস করলেন: "তোমাদের কি এমন কোন উক্তি জানা আছে যা শতভাগ ঈসা আলাইহিস সালাম বলেছেন তাতে নিশ্চিত?"

পাদ্রী ঈষৎ লজ্জিত বোধ করলেন কিন্তু সততার সাথে উত্তর দিলেন যে, "এমন কোন উক্তি জানা নেই যা পরিপূর্ণভাবে যাচাই করা যায়- কেননা তিনি যে ভাষায় কথা বলতেন তা হারিয়ে গেছে।"

এরপর পাদ্রী জিজ্ঞেস করলেন, "মুসলিমদের আছে কি"?

"তোমাদের কি এমন উক্তি জানা আছে যা শতভাগ মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] বলেছেন নিশ্চিত?"

ওই শিক্ষক মৃদু হাসলেন। আর বললেন, "আমাদের কেবল আমাদের কেবল নবীর [সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] সুনিশ্চিত আর সন্দেহাতীত কথা সম্বলিত বইয়ের সংগ্রহশালাই রয়েছে তা নয়, আমাদের একটি বিজ্ঞান [science] রয়েছে, যার নাম 'তাজওয়ীদ' [Tazweed]"। তাজওয়ীদ এর পড়াশুনা হচ্ছে, প্রত্যেকটি ধ্বনি আর বর্ণ যেভাবে নবী [সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] উচ্চারণ করতেন তদানুযায়ী শিক্ষা দেয়া !"

 সকল প্রশংসা আল্লাহ্ তা'আলার, যিনি আমাদের দ্বীনকে এভাবে হিফাজত করেছেন।

 কিন্তু, ভাই ও বোনেরা আমরা কি আল্লাহ্ এবং তার রাসূলের বাণীকে হিফাজত করায় আমাদের করণীয়টুকু করছি? রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: "প্রচার করো! একটি আয়াহ্ হলেও।" কিভাবে আমরা তা করতে সমর্থ হবো যদি আমরা নিজেরাই অবতীর্ণ আয়াহ্'টি না বুঝি? কিভাবে আমরা তা জানি এমন ধারনা করতে পারি যখন আমরা যে ভাষায় তা অবতীর্ণ হয়েছে সে ভাষাটিই বুঝি না। আর আল্লাহ্ আর তার রাসূলের মিশনকে সফল করতে হলে আমাদের উপর ইসলামের ভাষা [আরবী] শিখা আবশ্যক।

অন্যদের ইসলাম শিক্ষা দেয়া- একটি আয়াহ্ হলেও পৌছানোর পাশাপাশি আমাদের মাথায় রাখতে হবে; আমরা যেনো আরও একটি প্রজন্ম এই বিপাকে ধ্বংস না করি। দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষার হার বাড়ানো আর দ্বীনের শিক্ষাব্যবস্থা উভয়ক্ষেত্রে আমাদের জাতিগোষ্ঠীগুলো যেনো এগিয়ে আসে তা নিশ্চিত করতে হবে; যাতে আমরা সঠিক পথপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে এগিয়ে যেতে পারি।

 কুরআন হলো আল্লাহ্’র সাথে আমাদের সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যম; যাতে এর মাধ্যমে তিনি আমাদের তার নির্দেশিত পথের দিশা দান করতে পারেন। কিন্তু এই যোগাযোগ [communication] কি সত্যিই ঘটছে? যোগাযোগের উপর যে কোন পাঠ্য দেখলে আমরা দেখতে পাব, যোগাযোগ [communication] হচ্ছে প্রেরিত বার্তা প্রাপকের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছা আর তা সঠিকভাবে গ্রহণ করা তেমন অর্থবহভাবে; যেমন প্রেরকের উদ্দীষ্ট ছিলো। কিন্তু তা যদি শ্রবণের সমস্যার কারনে কিংবা অমনযোগিতার কারনে কিংবা ভাষাগত প্রতিবন্ধকতার কারনে যথার্থভাবে না পৌঁছে তবে সত্যিকার যোগাযোগ সম্পন্ন হয়েছে বলা যাবে না। এই ব্যাপারটি আল্লাহ্ এবং তার রাসূলের বাণীর ক্ষেত্রে ও প্রযোজ্য। আমরা কি সত্যিই আল্লাহ্’র সাথে যোগাযোগের অবকাশ রেখেছি যখন আমরা তার বাণীর মর্মার্থই উপলব্ধি করতে পারি না?

কেবল সরলীকৃত আর দুর্বল বাংলা কিংবা ইংরেজীতে অনূদিত  কুরআন পড়ে আমরা কখনোই কুরআন পরিপূর্ণভাবে বুঝতে সমর্থ হবো না। প্রত্যেক ভাষার নিজস্ব কিছু স্বকীয়তা আর নিগূঢ়তা রয়েছে যা কখনোই অনুবাদ করা সম্ভবপর নয় আর কুরআনের আরবীর ক্ষেত্রে তা অকল্পনীয়। এ প্রসঙ্গে জালালুদ্দীন সুয়ুতী রহিমাহুল্লাহ্’র একটি উক্তির ভাবার্থ উল্লেখ করতে চাই। তিনি যা বলেন তার ভাবার্থ অনেকটা এমন: “কেউ যদি আল্লাহ্’র সাথে তার সৃষ্টির দুরত্ব উপলব্ধি করতে পারে, তবে কুরআনের সাথে কুরআনের অনুবাদের পার্থক্য ও  উপলব্ধি করতে পারবে।“

আজ যদি রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কারো সাথে সরাসরি কথা বলতেন- আর স্বভাবতঃই তিনি তা আরবীতে বলতেন-তবে কি সে তা বুঝতে সমর্থ হতো? কিংবা তার কি অনুবাদক এর প্রয়োজন পড়তো? অথচ সে চাইতো প্রতিটি মুহুর্ত, প্রতিটি উপদেশ বুঝতে, ধরে রাখতে কিন্তু পারতঃপক্ষে তাকে অসহায়ভাবে দাড়িয়ে থাকতে হতো, তার সাথে যোগাযোগ করা কিংবা তার প্রজ্ঞা বুঝা সম্ভবপর হতো না; আরবী না জানার কারনে।

 আর যারা তার সংস্পর্শ পেয়েছিলো তারা এর [কুরআন] ছোঁয়ায় বদলে গিয়েছিলো। হাবশায় মুসলিমদের প্রথম হিজরতের পরপরই রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবার নিকটে সুরা নাজম তিলাওয়াত করেছিলেন আর তা মুসলিম-কাফির সকলেই তা সমবেতভাবে শুনেছিলো আর তাতে বিমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলো।

আর তিনি যখন চুড়ান্ত এই আয়াহ্’য় পৌঁছলেন:

"তোমরা কি এই বিষয়ে আশ্চর্যবোধ করছ? এবং হাসছ-ক্রন্দন করছ না? তোমরা ক্রীড়া-কৌতুক করছ, অতএব আল্লাহকে সেজদা কর এবং তাঁর ইবাদত কর।"[সুরা নাজম:৫৯-৬২]

 তৎক্ষনাৎ, রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিজদায় লুঠিয়ে পড়লেন আর উপস্থিত মুসলিমরা সকলেও তার অনুসরনে আল্লাহ্’র নিকট সিজদায় পড়ে গেলেন।

 এখন, এ ব্যাপারখানি একটু ভাবুন যা তৎপরবর্তীতে ঘটেছিলো! সকল উপস্থিত কাফিররাও আল্লাহ্’র সামনে সিজদারত হলো। তারা কুরআনের সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্যে এতটাই বিমোহিত হয়েছিলো এতে অন্তর্নিহিত সত্যকে অস্বীকার করতে পারে নি!

"আমি একে আরবী ভাষায় কোরআন রূপে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পার।" [সুরা ইউসুফ:০২]


 এখানে, কেবল একটি উদাহরণ দেয়া হলো যাতে এই ব্যাপারটি পরিচ্ছন্ন হয় যে, কুরআনের অনুবাদ অসম্ভব।
সুরা আবাসায় আল্লাহ্ সুবহানুহ তা’আলা ইয়ামুল কিয়ামাহ্’র কথা বলেছেন এভাবে:

"অতঃপর যেদিন কর্ণবিদারক নাদ আসবে," [সুরা আবাসা:৩৩]

এখানে, বিকট শব্দের [কর্ণবিদারক নাদ] জন্য ব্যবহৃত আরবী শব্দ হলো “সাককাহ্” [الصَّاخَّةُ]- শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া-যা পুনরুত্থানের ঘোষনা দিবে আর মানবসকলের দুনিয়ার সকল কাজের প্রতিদানের; যার ফলে অবিশ্বাস্য রকমের মোহাচ্ছন্নতার  অবতারনা ঘটাবে।

 الصَّاخَّةُ এই শব্দটি দেখে কেউ ভাবতে পারে এটিকে দুটি দ্বিরুক্তি কিংবা ধ্বনির মাধ্যমে উচ্চারণ করা হবে। কিন্তু আরবীতে الصَّاخَّةُ শব্দটি ছয় পর্যন্ত টেনে পড়া হয়। এর তিলাওয়াত শুনলেই ব্যাপারটি পরিচ্ছন্ন হবে। এই শব্দের তিলাওয়াত এমন যে শব্দটিই যেনো শিঙ্গায় ফুঁকদানের বিষয়টিকে প্রাণবন্ততা দেয়। কিন্তু ইংরেজীতে  কিংবা বাংলায় ‘deafening noise/deafening Blast’ কিংবা 'বিকট শব্দ' কে টেনে পড়ার কোন সুযোগ নেই; সুতরাং আল্লাহ্ আজ্জা ওয়া জাল যে শক্তিশালী অর্থ এখানে উদ্দেশ্য করেছেন তা আমরা কখনোই পাব না। কেবল যে আরবী ভাষা বুঝে সেই আল্লাহ্’র বাণীর সত্যিকার ক্ষমতা উপলব্ধিতে সমর্থ হবে; যা অত্যন্ত সতর্কতা আর সুগভীরতার সাথে তিনি আমাদের জন্য নির্বাচন করেছেন।

আরেকটি উদাহরণ, ধরুন আপনি একজন ইংরেজীভাষী আর একজন মনিব তার ভৃত্যকে বলছে “আমাকে পানি দাও”; আপনি বুঝে নিবেন যে মনিব স্বত্বরই পানি চেয়েছেন, দুই ঘন্টা পরে চান নি। এখানে তা বলা নেই কিন্তু নিহিত রয়েছে। আর এটাই ভাষার সূক্ষ্ন তারতম্য।

কেউ যখন বলে, “আরবী আমার নিকট ভিনদেশী ভাষা” যার ভাবার্থ হবে এমন, “কুরআনের উপলব্ধি আমার নিকট প্রকৃতিবিরুদ্ধ।” আর আরবী যখন কারো নিকট ভিনদেশী ভাষা হিসেবে পরিগনিত হয় তার অর্থ দাঁড়ায়: “রাসুলুল্লাহ্’র সুন্নাহ তার নিকট অপরিচিত।”

যে আল্লাহ্’কে ভালবাসে; সে এ ভালবাসার সুত্রে অবশ্যই রাসুলুল্লাহ্’কে ভালবাসে। আর যে আল্লাহ্ আর তার রাসূলকে ভালবাসে; সে এ ভালবাসার সূত্রে অবশ্যই ভালবাসবে আরবী ভাষাকে; যা আল্লাহ্ পছন্দ করেছেন।

এই সে ভাষা যাতে ‘পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বই’ কথা বলেছে। এই সে ভাষা যাতে পৃথিবীর সর্বশ্রষ্ঠ মানুষ কথা বলেছেন। আর এটি অন্যান্য ইসলামী বিষয়াদি উপলব্ধির জন্য প্রবেশদ্বার। আর যে কখনো আরবী শিখবে না সে কখনো কুরআন আর সুন্নাহ্ পরিপূর্ণভাবে বুঝতে সমর্থ হবে না।

আরবী শিখা আমাদের কি উপকারে আসবে?

এক: এটি আমাদের চরিত্রকে নমনীয় করবে।

ইবনে তাইমিয়াহ্ বলেন: “একটি ভাষার ব্যবহার একজনের চিন্তা, আচরণ আর দ্বীনের প্রতি নিষ্ঠায় যথার্থই প্রভাব ফেলে। এটি উম্মাহ্’র প্রথমদিকের প্রজন্ম: সাহাবী আর তাবিয়ুনদের সাদৃশ্যমান অনুকরণের ক্ষেত্রেও একজনের উপর প্রভাব ফেলে। তাদের অনুকরণের প্রচেষ্টা একজনের চিন্তা, আচরণ আর দ্বীনের প্রতি নিষ্ঠায় বিশুদ্ধতার ছাপ ফেলে।”

দুই: আর এটি ইসলামী সংস্কৃতির সাথে আমাদের যোগসূত্র। নিঃসন্দেহে, ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি; যে ভাষা শিখা হয় তার সংস্কৃতি চিন্তা আর আচরণের উপর প্রভাব বিস্তার করে। আর আরবী ভাষার মাধ্যমে ইসলামী পরিশুদ্ধ সংস্কৃতির নিকট আসতে পারা বিশাল সৌভাগ্যের ব্যাপার।

ইমাম শাফিঈ বলেন: "লোকজন ততক্ষণ অজ্ঞতায় নিমজ্জিত হয় নি আর নিজেদের মধ্যে মতবিরোধে লিপ্ত হয় নি; যতক্ষণ তারা আরবী ভাষা ছেড়ে দেয় নি আর আ্যরিস্টটলের ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়ে নি।" [ সিয়ার আ'লাম আল-নুবালা - আয-যাহাবী: ১০:৭৪ এবং সউন আল-মানতিক - সুয়ুতী: পৃষ্ঠা-১৫]

যারা ভাবে ইংরেজী শিখা দুনিয়াতে সাফল্য নিয়ে আসবে তাদের জন্য বলি, আরবী শিখা তোমার পরকালের সাফল্যের পূর্বশর্ত। আর মুসলিমরা যখন বিশ্বশাসণ করছিলো তখন অমুসলিমদের আরবী জানাটা ছিলো শিক্ষিত হওয়ার লক্ষন। আবার ও বিশ্ব ফিরে যাবে সেই গৌরবময় ইসলামী ইতিহাসে, ইনশা’আল্লহ্।

কোন মুসলিমেরই এই ভাবনা ভাবার অবকাশ নেই যে, আরবী তার মাতৃভাষা নয়। বরং তা আমাদের দ্বীনের ভাষা, বিশ্বাসের ভাষা। আর লোকজনকে এই ভাষার দিকে আহবান করায় জাতীয়তাবাদী সংকীর্ণতা নাই; বরং এই আহবানে একজন মুসলিম মাথা উচিয়ে বলবে, “আমার বিশ্বাসের একটি স্বকীয় ভাষা আছে আর তা হলো আরবী!”

[কৃতজ্ঞতা: 'Kalamullah' এর একটি প্রবন্ধ অবলম্বনে।]