Saturday 25 May 2013

শুবুহাত [সন্দেহ] আর শাহওয়াহ্ [কুপ্রবৃত্তি] এর ফিতনাহ্- মূল: ইবনুল কায়্যিম

[লিখাটি খানিক দীর্ঘ; ধৈর্যসহকারে পড়ার অনুরোধ]

بسم الله الرحمن الرحيم


শুবুহাত [সন্দেহ]’র ফিতনাহ্:

ফিতনাহ্ দুই প্রকার: শুবুহাত [সন্দেহ]’র ফিতনাহ্, যা দুই ফিতনাহ্’র মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভয়াবহ যার অপরটি শাহওয়াতের [কুপ্রবৃত্তি] ফিতনাহ। এটা খুবই সম্ভব যে এই দুই ফিতনাহ্ একজন আবদের [বান্দা] মধ্যে একইসাথে উপস্থিত থাকতে পারে অথবা এর যে কোন একটি অন্যটির উপস্থিত ব্যতিরেকে।

শুবুহাতের ফিতনাহ মূলতঃ দুর্বল অন্তর্দৃষ্টি আর জ্ঞানের অপ্রতুলতার কারনে হয়। আর এর সাথে যদি যুক্ত হয় মন্দ উদ্দেশ্য আর নিজের কামনা চরিতার্থ করা; এর মধ্যে লুকায়িত রয়েছে ভয়াবহতম বিশৃংখলা আর মন্দতম বিপর্যয়। আপনি এই ধরনের পদস্খলনের মন্দ অভিপ্রায়কে যাই বলুন এর মূলে রয়েছে এরূপ ব্যক্তির প্রবৃত্তির অনুসরন; হুদা [পথনির্দেশিকা]’র নয়, সাথে তার দুর্বল অন্তর্দৃষ্টি আর অপ্রতুল জ্ঞান তার সম্বন্ধে: যা রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়ে এসেছেন। মূলতঃ সে ব্যক্তি তার ন্যায় যার সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

“এগুলো কতগুলো নাম বৈ নয়, যা তোমরা এবং তোমাদের পূর্ব-পুরুষদের রেখেছ। এর সমর্থনে আল্লাহ কোন দলীল নাযিল করেননি। তারা অনুমান এবং প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে। অথচ তাদের কাছে তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে পথ নির্দেশ এসেছে।“ [সুরা নাজম: ২৩]


আর নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের জানিয়েছেন যে প্রবৃত্তির অনুসরণ যে কাউকে আল্লাহ্’র পথ হতে সরিয়ে দেয়। আল্লাহ্ আজ্জা ওয়া’জাল বলেন:

“হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, অতএব, তুমি মানুষের মাঝে ন্যায়সঙ্গতভাবে রাজত্ব কর এবং খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না। তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দেবে। নিশ্চয় যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি, এ কারণে যে, তারা হিসাবদিবসকে ভূলে যায়।“ [সুরা ছোয়াদ: ২৬]

[ইগাছাতুল লাহফান ফি মাসায়্যিদুশ শায়তান - ইবনুল কায়্যিম, ভলিউম: ০২, পৃষ্ঠা ২৩৯-২৪২ এর সারসংক্ষেপ]

এই ধরনের ফিতনাহ্ কুফর [অবিশ্বাস] আর নিফাকের [কপটতা] দিকে ধাবিত করে। এই ধরনের ফিতনাহ্ হচ্ছে মুনাফিক আর আহলুল বিদ’আহ্’দের; তাদের বিদ’আহ্’র মাত্রা অনুযায়ী তা হয়। এভাবে, তাদের অধিকাংশই নতুন বিষয় উদ্ভাবন করে শুবুহাতের ফিতনাহ্’র কারনে; যেখানে তারা সত্যের সাথে মিথ্যার মিশ্রণ ঘটায় আর হিদায়া্হ্’র সাথে ভ্রান্তির।


এই ধরনের ফিতনাহ্’র পঙ্কিলতা থেকে মুক্তির আর কোন উপায় নেই; রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ ব্যতীত। তাকে (আলাইহিস সালাম) সমস্ত সুক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ দ্বীনি বিষয়সমুহের পাশাপাশি সহজ বিষয়সমুহ, তার জীবনের প্রকাশ্য আর গোপনীয় ক্ষেত্রসমুহ, তার বিশ্বাস আর কর্মসমুহ, তার বাস্তবতা আর বিধানসমুহের ক্ষেত্রে মানদন্ড হিসেবে নিযুক্ত করে; এভাবে সে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে ঈমানের স্বরূপ আর ইসলামের বিধানসমুহ গ্রহণ করে। সে তার (আলাইহিস সালাম) কাছ থেকে আরো গ্রহণ করে, যা (আলাইহিস সালাম) তিনি আল্লাহ্’র নাম, গুণাবলী আর কর্মসমুহ সম্পর্কে নিশ্চিত করেছেন আর সে তা প্রত্যাখান করে না। এভাবে, সে তার (আলাইহিস সালাম) কাছ থেকে গ্রহণ করে ছ্বলাতের বাধ্যবাধকতা, এর সময়সূচী আর দৈনিক ওয়াক্ত, একজন মানুষকে কি পরিমান সম্পদের যাকাহ্ দিতে হবে আর কারা এর প্রাপ্য, ওজু আর গোসলের (জানাবাহ্’র ক্ষেত্রে)বাধ্যবাধকতা, রমাদানে সিয়াম পালনের বা্ধ্যবাধকতা প্রভৃতি। সে তাকে (আলাইহিস সালাম) কেবল একজন রাসূল হিসেবে দ্বীনের কিছু ক্ষেত্রে অনুসরণ করবে অন্যক্ষেত্রসমুহে বাদ দিয়ে; বরং তা নয়, তিনি (আলাইহিস সালাম)উম্মাহ্’র প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণীয় রাসূল: হোক তা জ্ঞানে কিংবা কর্মে। সুতরাং, সে অন্য কিছু গ্রহণ করবে না কিংবা নিবে না; তার (আলাইহিস সালাম) কাছ হতে ব্যতীত। কেননা, সমস্ত হিদায়াহ্’র উৎসরণ তার (আলাইহিস সালাম)কথা এবং কাজে। আর তার (আলাইহিস সালাম) হিদায়াহ্ বহির্ভূত সবকিছুই পথভ্রষ্টতা। আর এই মূলনীতি যখন একজন বান্দার অন্তরে প্রোথিত হয় আর সে নিজেকে সবকিছু থেকে ফিরিয়ে নেয় যা রাসুলুল্লাহ্ আনীত হিদায়াহ্ পরিপন্থী; তখন সে যে কোন ক্ষেত্রে, যে কোন সময় নিরীক্ষাধীন বিষয়কে বিচার করে সে জ্যোতি দ্বারা রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়ে এসেছেন: আর তা যদি তার (আলাইহিস সালাম) আনীত বিধানের সাথে মিলে যায় তবে সে তা গ্রহণ করে। আর তা এই কারনে নয় যে, কোন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি তা বলেছে বরং সে তা গ্রহণ করে কারণ তা সুন্নাহ্’র সাথে মিলে যায় আর তা সুন্নাহ্’বিরোধী হলে সে তা প্রত্যাখান করে; এটি বিবেচনা না করে, তা কার নিকট থেকে এসেছে। আর, এটিই কোন ব্যক্তিকে শুবুহাত থেকে রক্ষা করবে আর তার মধ্যে যদি এই মূলনীতি অনুপস্থিত থাকে তবে সে এই ফিতনাহ্ দ্বারা আক্রান্ত হবে ততোধিক যতটা সে এই মূলনীতিকে উপেক্ষা করে।

এই ফিতনাহ্ কখনো ভুল বোঝা, অযথার্থ তথ্য, সত্য উপস্থিত আর প্রমাণিত থাকার পর ও অসতর্কতার কারণে তা থেকে যথার্থ শিক্ষা নিতে অসমর্থ হওয়া, অথবা কখনো কোন ব্যক্তির নিজের মন্দ উদ্দেশ্য আর তার প্রবৃত্তির অনুসরণের ফলে সে ঐসকল ব্যক্তি যারা অন্তর্দৃষ্টি হারিয়ে অন্ধত্ববরণ করে আর যারা নিজেদের উদ্দেশ্যে মন্দ আশ্রয় নেয়; তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়।

শাহাওয়াহ্ [কুপ্রবৃত্তি]’র ফিতনাহ্:

নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা’আলা নিচের আয়াহ্’য় ঐ সকল ব্যক্তির স্বরূপ উল্লেখ করেছেন, যারা এই দুই ধরনের ফিতনাহ্ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে:

"যেমন করে তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তোমাদের চেয়ে বেশী ছিল শক্তিতে এবং ধন-সম্পদের ও সন্তান-সন্ততির অধিকারীও ছিল বেশী; অতঃপর উপকৃত হয়েছে নিজেদের ভাগের দ্বারা আবার তোমরা ফায়দা উঠিয়েছ তোমাদের ভাগের দ্বারা-যেমন করে তোমাদের পূর্ববর্তীরা ফায়দা উঠিয়েছিল নিজেদের ভাগের দ্বারা। আর তোমরাও বলছ তাদেরই চলন অনুযায়ী। তারা ছিল সে লোক, যাদের আমলসমূহ নিঃশেষিত হয়ে গেছে দুনিয়া ও আখেরাতে। আর তারাই হয়েছে ক্ষতির সম্মুখীন।" [সুরা তওবাহ: ৬৯]

এখানে, আল্লাহ্ তা’আলা উল্লেখ করেছেন আমাদের কাছে, কি হয়েছিলো তাদের অন্তর আর দ্বীনের বিকৃতির ফলে। কেননা, তারা দুনিয়ার ভোগসামগ্রীর মোহগ্রস্থতা আর মিথ্যাচারিতায় জড়িয়ে পড়েছিলো। আর, দ্বীনের বিকৃতি সাধিত হয় মিথ্যাচারিতা আর তাতে জড়িয়ে পড়া কিংবা সেই সকল কর্মে জড়িয়ে পড়া যা সঠিক কর্মপন্থার পরিপন্থী।

প্রথম ফিতনার ক্ষেত্র হলো বিদ’আহ্ আর তার ফলশ্রুতি। আর দ্বিতীয়টি হলো পাপকাজে জড়িয়ে পড়া। প্রথমটি (বিদ’আহ্) হলো শুবুহাতের ফলশ্রুতি আর দ্বিতীয়টি (পাপকাজে জড়িয়ে পড়া) হলো শাহওয়াতের ফলশ্রুতি।

এজন্য সালাফরা বলতেন: “দুই ধরনের লোক হতে সতর্ক হও: ঐ ব্যক্তি যে প্রবৃত্তি অনুসৃত (বিদ’আহকারী) যার প্রবৃত্তি তাকে পথভ্রষ্ট করেছে আর ঐ ব্যক্তি যে দুনিয়াদার (বস্তুবাদী) যাকে দুনিয়া অন্ধ করে দিয়েছে।”

সালাফরা আরো বলতেন: “দুষ্ট জ্ঞানী আর অজ্ঞ উপাসণাকারীর ফিতনাহ্ হতে সতর্ক হও; কেননা তাদের ফিতনাহ্ প্রত্যেক পথভ্রষ্টদের আক্রান্ত করে।”

সকল ফিতনাহ্’র উৎস হলো আল্লাহ্’র বিধানের উপর মতামতকে প্রাধান্য দেয়া, আর বুদ্ধিবৃত্তির উপর প্রবৃত্তিকে প্রাধান্য দেয়া। এভাবে, আমরা দেখি প্রথম ফিতনাহ্’র ভিত্তি শুবুহাত আর দ্বিতীয় ফিতনাহ্’র ভিত্তি হলো শাহ্ওয়াত।

এই দুই ফিতনাহ্’র নিরাময়:

শুবুহাতের ফিতনাহ্’র প্রতিরোধ আর নিরাময় করতে হবে আল-ইয়াকীন (সুনিশ্চিত জ্ঞান)আর শাহওয়াতের ফিতনাহ্ নির্মূল আর সারিয়ে তুলতে হবে আস-সবর (ধৈর্য) দ্বারা। আর এই কারণেই আল্লাহ্ তা’আলা এই দুই গুণাবলীকে তার দ্বীনের নেতৃত্বের প্রয়োজনীয় গুণের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। এজন্যই, আল্লাহ্ আজ্জা ওয়া’জাল বলেন:

“তারা সবর করত বিধায় আমি তাদের মধ্য থেকে নেতা মনোনীত করেছিলাম, যারা আমার আদেশে পথ প্রদর্শন করত। তারা আমার আয়াতসমূহে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিল।“[সুরা সাজদাহ্:২৪]

আর এটাই নির্দেশ করে, ধৈর্য আর সুনিশ্চিত জ্ঞানের মাধ্যমে একজন দ্বীনি নেতৃত্বের যোগ্যতা অর্জন করে। আল্লাহ্ তা’আলা এই দুই বৈশিষ্ঠ্যের সম্মিলন ঘটিয়েছেন সুরা আসরে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

“কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকীদ করে সত্যের এবং তাকীদ করে সবরের।“[সুরা আসর: ০৩]

অতএব, একে অপরকে সৎকাজের আদেশ শুবুহাতকে দূরীভূত করে আর ধৈর্যের উপদেশ পরস্পরকে বিরত রাখে প্রবৃত্তির অনুসরণ হতে। সুতরাং, ধৈর্য আর সুস্হ বুদ্ধিবৃত্তি একজনকে শাহ্ওয়াতের ফিতনাহ্ থেকে নিবৃত্ত রাখে আর পরিচ্ছন্ন অন্তর্দৃষ্টি আর সুনিশ্চিত জ্ঞান তাকে দুরে রাখে শুবুহাতের ফিতনাহ্ হতে এবং আল্লাহ্’র সাহায্যই কাম্য।

[অনূদিত: ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসনুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন]

No comments:

Post a Comment